পেহেলগামের ঘটনার পর ভারতজুড়ে কাশ্মীরিদের হয়রানি

ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পাঞ্জাবের জলন্ধরের সরু ও জনাকীর্ণ গলির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসিফ দার হঠাৎ বুঝতে পারলেন, ‘সকলের নজর তার দিকে। আর সেগুলো বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। তিনি স্মরণ করে বললেন, আমার মনে হচ্ছিল যেন ভিড়ের প্রতিটি মানুষের চোখেই প্রতিশোধের ভাব ফুটে উঠেছে।
আসিফ এবং তার এক বন্ধু যখন এটিএম বুথ-এর কাছে থামলেন, তখন দু’জন অজ্ঞাত ব্যক্তি তাদের কাছে এগিয়ে এসে তাদের জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেলেন।
পরের দিন, ২৩ এপ্রিল সকালে আসিফ দুধ কিনতে তার বাড়ি থেকে বের হলেন। তিনি বলছিলেন, তিন জন লোক আমাকে দেখে ইসলামোফোবিক গালিগালাজ করল। তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলল, ‘সে একজন কাশ্মীরি, তাদের কারণেই সবকিছু ঘটে।’
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) কাশ্মীরের রিসোর্ট শহর পহেলগামে বন্দুকধারীরা পর্যটকদের ওপর গুলি চালায়। এতে ২৬ জন পর্যটক নিহত এবং আরও এক ডজন আহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড দেশটির ধর্মীয় ও জাতিগত বিভেদ উন্মোচিত করেছে।
ভারত সরকার কাশ্মীরের ঘন জঙ্গল এবং পাহাড়ে আক্রমণকারীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে দেশজুড়ে বসবাসকারী কাশ্মীরিরা, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা, উগ্র ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর – এমনকি তাদের সহপাঠীদের বিরুদ্ধে হেনস্থা, হয়রানি এবং হুমকির অভিযোগ করেছে।
উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব থেকে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত, বাড়িওয়ালারা কাশ্মীরি ভাড়াটেদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন। দোকানদাররা তাদের সঙ্গে লেনদেন করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
আসিফ বলছিলেন, অন্য কেউ এই মারাত্মক আক্রমণটি ঘটিয়েছে। এখন আমাদের মূল্য দিতে হবে!
‘আমি যেদিকেই তাকাই অবিশ্বাস’
বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলটি সম্পূর্ণরূপে দাবি করা হলেও এর কিছু অংশ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের শাসিত। নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে ‘সীমান্ত সন্ত্রাসবাদ’ এবং পহেলগাম হামলায় পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা কেবল কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদকে নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ ভারত দেয়নি।
এরপর নয়াদিল্লি পানিবণ্টন চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, উভয় দেশ একে অপরের নাগরিকদের বহিষ্কার করছে এবং একে অপরের রাজধানীতে তাদের মিশনের কূটনৈতিক শক্তি হ্রাস করছে। কিন্তু ভারতের ভেতরে, মঙ্গলবারের হামলার ক্ষোভের সবচেয়ে বেশি চাপ কাশ্মীরিদের ওপর পড়ছে।
আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলা প্রায় এক ডজন কাশ্মীরি, যাদের সকলেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, তারা সবসময় রুমের মধ্যে আটকে থাকছেন। অনলাইনে অর্ডার দেওয়া বা ক্যাব বুকিংসহ বাইরের সব যোগাযোগ এড়িয়ে চলছেন।
আসিফ দার জলন্ধরে অ্যানেস্থেসিয়া এবং অপারেশন থিয়েটার টেকনোলজির দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বাবা-মা এবং কাশ্মীর ছেড়ে এই প্রথম ভারতের শহরে এসেছেন।
তিনি ফোনে সাক্ষাৎকারে আল জাজিরাকে বলেন, কাশ্মীরে কোন পড়াশোনার সুযোগ নেই এবং আমি আমার ভবিষ্যতের জন্য কঠোর পড়াশোনা করতে চাই। আমি যদি এখানে ভালো করি, তাহলে আমি আমার পরিবারকে সাহায্য করতে পারব।
কিন্তু বাস্তবতা তার জন্য খুবই দুঃখজনক। টার্ম পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে দার বলেন, এই মাসগুলোতে আমি যা শিখেছি, তা সব ভুলে গেছি। একটি অবিরাম অনিশ্চয়তা রয়েছে ভেতরে – আমি হয়তো (ক্লাসে) অনুপস্থিত থাকতে পারি; আবার মনে হয় বাড়িতে ফিরে যাই, আমি জানি না, আমার মাথা ঠিক কাজ করছে না।
তিনি বলেন, আমি যে দিকেই তাকাই না কেন, অবিশ্বাসই চোখে পড়ে। আমরা অভিশপ্ত, কারণ আমাদের মুখ এবং বৈশিষ্ট্য আমাদের জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করে।
হামলার পরপরই বেঁচে যাওয়া একাধিক ব্যক্তির বক্তব্য উঠে আসে, যা থেকে বোঝা যায়, বন্দুকধারীরা ধর্মের ভিত্তিতে আক্রমণকারী পর্যটকদের আলাদা করেছিল। নিহত ২৬ জনের মধ্যে ২৫ জন হিন্দু পুরুষ ছিলেন।
কিন্তু মঙ্গলবার থেকে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কাশ্মীরি-বিরোধী এবং মুসলিম-বিরোধী ঘৃণার ঝড়ে নিহত ২৬তম ব্যক্তির পরিচয় মূলত বাদ পড়ে গেছে: একজন কাশ্মীরি মুসলিম ব্যক্তি, যিনি পর্যটকদের হত্যা থেকে আক্রমণকারীদের থামানোর চেষ্টা করেছিলেন।
জলন্ধর থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে, উত্তরাখণ্ড রাজ্যের রাজধানী দেরাদুনে একটি অতি-ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী দলের নেতা গত মঙ্গলবার একটি ভয়াবহ সতর্কতা জারি করেছেন। হিন্দু রক্ষা দলের নেতা ললিত শর্মা একটি ভিডিও বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা সরকারের পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করব না… কাশ্মীরি মুসলমানরা, সকাল ১০টার মধ্যে চলে যাও, অন্যথায় তোমাদের এমন পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হবে যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
কাশ্মীরে অবস্থানরত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ শেখ শওকত বলেন, আজকের ভারত বিদেশিদের প্রতি ঘৃণামূলক প্রচারণার ওপর জোর দিচ্ছে এবং কয়েক বছর ধরেই তা চলছে। এর (ভারতের) বেশিরভাগই মুসলমানদের বিরুদ্ধে। কাশ্মীরিদের উপর দ্বিগুণ বোঝা চাপানো হয়: একজন কাশ্মীরি হওয়া এবং একজন মুসলিম হওয়া। তারা সবসময়ই সহজ লক্ষ্যবস্তু!
-আলজাজিরা