ভারত কি সমলিঙ্গের বিয়েকে বৈধতা দিতে প্রস্তুত?
সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়ের বৈধতা চেয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে যে আবেদন জানানো হয়েছে, আদালতে মঙ্গলবার তার চূড়ান্ত শুনানি শুরু হবে। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, “জনস্বার্থে এই শুনানি লাইভস্ট্রিমে” দেখানো হবে। খবর বিবিসি।
ভারতের সমলিঙ্গের দম্পতি এবং এলজিবিটিকিউ+ কর্মীরা আশা করছেন আদালতের রায় তাদের পক্ষে যাবে। অন্যদিকে ভারতের সরকার এবং ধর্মীয় নেতারা সমলিঙ্গের বিয়ের তীব্র বিরোধিতা করছেন। কাজেই আদালতে এ নিয়ে বিতর্ক বেশ প্রাণবন্ত হবে বলেই মনে হচ্ছে।
যারা সুপ্রিম কোর্টের এই শুনানি বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখবেন, তাদের মধ্যে আছেন সম-লিঙ্গের দম্পতি ড. কবিতা অরোরা এবং অংকিতা খান্না। তারা বহু বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন, কবে তারা বিয়ে করতে পারবেন।
কবিতা এবং অরোরা প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েছেন, ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতের ১৭ বছর পর এবং এক দশক ধরে একসঙ্গে থাকার পরও তারা বিয়ে করতে পারছেন না, যেটা কিনা বেশিরভাগ দম্পতিই চান। সুপ্রিম কোর্টে যে প্রায় দেড় ডজন দম্পতি সমলিঙ্গের বিয়ের বৈধতা চেয়ে আবেদন করেছেন, এই দম্পতিও আছেন তাদের মধ্যে। আবেদনকারীদের মধ্যে অন্তত তিন দম্পতি আছেন, যারা একসঙ্গে তাদের সন্তানদেরও বড় করছেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এটিকে “খুবই গুরুত্বপূর্ণ” এক বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং এই মামলার শুনানির জন্য পাঁচ সদস্যের একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করেছেন। আইনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্যই সাধারণত এরকম বেঞ্চ গঠন করা হয়।
ভারতে লাখ লাখ এলজিবিটিকিউ+ মানুষ আছেন, কাজেই এই বিতর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকার ২০১২ সালে জানিয়েছিল, দেশটিতে এরকম মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে অনুমান করা হয়, ভারতের মোট জনসংখ্যার অন্তত দশ শতাংশ, বা সাড়ে তের কোটি মানুষ হয়তো এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়বে।
কাজেই সামনের দিনগুলোতে সর্বোচ্চ আদালত কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার দিকে বিরাট মনোযোগ রয়েছে অনেকের। যদি আদালতের সিদ্ধান্ত সম-লিঙ্গের বিয়ের পক্ষে যায়, তাহলে ভারত হবে বিশ্বে এ ধরণের ৩৫তম দেশ। এটি ভারতের বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। আদালত এরকম সিদ্ধান্ত দিলে ভারতে সন্তান দত্তক নেওয়া, বিয়ে-বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার বা এরকম আরও অনেক বিষয়ের আইনে তখন পরিবর্তন আনতে হবে।
অংকিতা এবং কবিতা বলছেন, তারা আশা করছেন এরকমটাই ঘটবে, কারণ এর ফলে তারা দুজন বিয়ে করতে পারবেন।
অংকিতা একজন থেরাপিস্ট, আর কবিতা একজন মনোচিকিৎসক। তারা দুজনে মিলে একটি ক্লিনিক চালান, যেখানে তারা মূলত শিশু এবং তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করেন।
অংকিতা এবং কবিতা ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন।
“আমরা আমাদের সম্পর্কের এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি, যেখানে আমরা বিয়ে নিয়ে ভাবছি। আর আমরা সিস্টেমের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, যতবারই আমরা কিছু করতে যাই, এই সমস্যায় পড়ি। যেমন একটা জয়েন্ট ব্যাংক একাউন্ট খোলা, একটি স্বাস্থ্য বীমা করা, একটা বাড়ি কেনা কিংবা একটা উইল লেখা।”
একটা ঘটনা তাদেরকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। অংকিতার মায়ের একটি জরুরী অপারেশন করা দরকার ছিল, কিন্তু কবিতা যখন তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন, তখন তাকে বলা হলো এই অপারেশনের সম্মতিপত্রে তিনি সই করতে পারবেন না, কারণ “আমি বলতে পারছিলাম না যে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা কী, তিনি কি আমার মা নাকি আমার শাশুড়ি।”
তবে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যখন তারা নিজেদের এলাকার ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে গেলেন তাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো।
এই দম্পতি এরপর দিল্লি হাইকোর্টে গেলেন এবং সম-লিঙ্গের বিয়ের আইনগত বৈধতা চেয়ে আবেদন করলেন। তারা তাদের বিয়ে নিবন্ধনের আদেশ দেওয়ার জন্যও আদালতে প্রার্থনা জানালেন।
ভারতের বিভিন্ন এলাকার হাইকোর্টে এবং সুপ্রিম কোর্টে এরকম আরও কয়েকটি আবেদন করা হয়েছিল। এরপর গত জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট এসব মামলা একসঙ্গে শুনানির সিদ্ধান্ত নেয়, আদালত বলে, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।
অংকিতা এবং কবিতা তাদের সিনিয়র আইনজীবী মেনাকা গুরুসোয়ামী এবং অরুন্ধতী কাটজুর মাধ্যমে যে আবেদন করেছিলেন, সেখানে তারা বলেছিলেন, “আমরা আমাদের মতো করে যেন থাকতে পারি, আমরা সেটা চাইছি না, আমরা চাইছি আমাদের সমান মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।”
তাদের আবেদনে বলা হয়েছিল, ভারতীয় সংবিধান সব নাগরিককেই তাদের পছন্দের কাউকে বিয়ে করার অধিকার দিয়েছে, কার যৌন পরিচয় কী, সেটির ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করেছে। কাজেই আবেদনকারীদের আর্জি অনুমোদন করা হোক, কারণ “সাংবিধানিক নৈতিকতার স্থান সামাজিক নৈতিকতার উপরে।”
“আমি খুবই আশাবাদী এবং বিচার বিভাগের ওপর আমার আস্থা আছে”, বিবিসিকে বলছিলেন মিজ গুরুসোয়ামী, যিনি আদালতে ছয়টি সমলিঙ্গের বিয়ের মামলায় আইনজীবী হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
কবিতার বাবা-মার সঙ্গে থাকেন অংকিতা এবং কবিতা
এর আগে ২০১৮ সালে ভারতের আদালত ‘সমকামী যৌন সম্পর্ক’ আর অপরাধ বলে গণ্য হবে না বলে যে রায় দিয়েছিল, সেটি মিজ গুরুসোয়ামীকে বেশ আশাবাদী করে তুলেছে। “যেটা আমাকে সবচেয়ে আলোড়িত করেছে তা হলো, আদালত মানুষের জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের অধিকারের ওপর জোর দিয়েছে, সেটাই আমাকে বেশি আশাবাদী করেছে”, বলছিলেন তিনি।
ঔপনিবেশিক আমলের এ সংক্রান্ত আইন বাতিলের সময় আদালত বলেছিল, “এলজিবিটি মানুষদের সঙ্গে সমাজ যে বর্বরতা এবং অসম্মান দেখিয়েছ, সেজন্যে তাদের কাছে ইতিহাসের অনেক ক্ষমা চাওয়ার দায় আছে।”
কিন্তু সমলিঙ্গের বিয়ের বিরুদ্ধে সরকার এবং ধর্মীয় নেতারা যেরকম জোরালো বিরোধিতার অবস্থান নিয়েছেন, মিজ গুরুসোয়ামীকে বেশ শক্ত লড়াই চালাতে হবে।
ভারত সরকার এরই মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এই আবেদন নাকচ করে দেওয়ার জন্য । সরকার বলেছে, কেবলমাত্র দুই বিপরীত লিঙ্গের মানুষ, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যেই বিয়ে হতে পারে।
আদালতে ভারতের আইন মন্ত্রণালয় তাদের আবেদনে বলেছিল, “সম-লিঙ্গের মানুষদের জীবনসঙ্গী হিসেবে একসঙ্গে বসবাস করা এবং তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক… এসব ভারতে পরিবারের যে ধারণা, একজন স্বামী, একজন স্ত্রী, সন্তান.. এসবের সঙ্গে খাপ খায় না।”
আবেদনে আরও বলা হয়েছিল, একটি দেশের পুরো আইন প্রণয়ন নীতি বদলানোর জন্য আদালতকে বলা যায় না, এটি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের এখতিয়ার পার্লামেন্টের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।
সমলিঙ্গের বিয়ের বিরোধিতার ব্যাপারে ভারতে সব ধর্মের নেতাদের মধ্যে এক বিরল ঐক্য দেখা গেল- হিন্দু, মুসলিম, জৈন, শিখ এবং খ্রিস্টান- সব ধর্মের নেতারাই সমলিঙ্গের মানুষদের মধ্যে বিয়ের বিরোধিতা করলেন। তারা বললেন, বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রজননের মাধ্যমে বংশধারা অক্ষুন্ন রাখা , বিয়ে বিনোদনের জন্য নয়।
এবং গত মাসে হাইকোর্টের ২১ জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকও এই ইস্যুতে জড়ালেন। তারা এক খোলা চিঠিতে লিখলেন, “সমলিঙ্গের বিয়ের জন্য যদি আইন করা হয়, পরিবার, সমাজ এবং শিশুদের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।”
এই বিচারকরা আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে, সমলিঙ্গের মানুষের বিয়েকে বৈধতা দিলে ভারতে এইচআইভি-এইডস বেড়ে যাবে। তারা আরও বলেছিলেন, এধরণের দম্পতিরা যেসব ছেলে-মেয়েকে বড় করবে, তাদের মানসিক বিকাশেও সমস্যা তৈরি হবে।
কিন্তু গত সপ্তাহে ভারতের সাইক্রিয়াটিক সোসাইটি আবেদনকারীদের পক্ষে এক বিবৃতি দেয়, যেটি তাদের খুব আশাবাদী করে তুলেছে। এই বিবৃতিতে সাত হাজার ভারতীয় মনোচিকিৎসকের সংগঠন ইন্ডিয়ান সাইক্রিয়াটিক সোসাইটি বলেছে, “সমকামিতা কোন অসুখ নয়।” তারা আরও বলেছে, এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের সঙ্গে যদি বৈষম্য করা হয়, সেটাই বরং তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা তৈরি করবে।
আমি অংকিতা এবং কবিতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আদালতে কী ঘটবে বলে তাদের ধারণা?
“আমরা জানি যে আমাদের সংবিধান এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে সবাইকে সমতা দেয়া হয়েছে, বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কাজেই সংবিধান এবং বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের অগাধ আস্থা আছে”, বললেন অংকিতা।
তার কথার সঙ্গে কবিতা যোগ করলেন, “আমরা জানি অনেক বিরোধিতা হবে, আমরা জানি, এই কাজ সহজ হবে না। কিন্তু তারপরও আমরা এই পথ বেছে নিয়েছি, আমরা এই যাত্রা শুরু করেছি। দেখা যাক এটি আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।”
এবিসিবি/এমআই