নারী নিগ্রহে উত্তাল ভারত

ভারতের সংঘাতময় মণিপুর রাজ্যে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় ঘোরানোর ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশটি। বিরোধীরা এ ঘটনায় সরকারের তীব্র সমালোচনা করে সংসদে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। সরকারের সমালোচনা করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালতও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নারী নিগ্রহের এ ঘটনাকে ‘জাতীয় লজ্জা’ বলে মন্তব্য করেছেন।
গত ৪ মে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরের কাংপোকপি জেলায় এ ঘটনা ঘটেছে। সেদিন পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দুই মধ্যবয়সী নারীকে নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো হয়। তাদের দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। মে মাসের শুরু থেকেই উত্তাল ভারতের উত্তর-পূর্বের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মণিপুর। দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে দফায় দফায় আগুন জ্বলছে ওই রাজ্যে। নারী নিগ্রহের এমন ভিডিও ভাইরাল হতেই শিউরে উঠেছে পুরো ভারত। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ ও রাজ্যের মুখ্য় সচিবকে তড়িঘড়ি ফোন করে অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।
গত ৩ মে ‘ট্রাইবাল সলিডারিটি মার্চ’ শুরু করে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব মণিপুর’। মেতেইদের তপশিলি উপজাতির মর্যাদা না দেওয়ার দাবিতেই ছিল এ কর্মসূচি। ক্রমে তা হিংসাত্মক আকার ধারণ করে। মেতেইরা সংখ্যাগুরু ইম্ফল উপত্যকায় বেশ কিছু বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর জেরে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে হিংসা। এখন পর্যন্ত এ সহিংসতায় শতাধিক লোক মারা গেছে। এখনও মণিপুর কার্যত নরককুণ্ড।নারী নিগ্রহে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের করা এফআইআরে বলা হয়েছে, মেতেইদের আক্রমণের মুখে গত ৪ মে এক কুকি পরিবারের পাঁচ সদস্য লুকিয়ে পড়েছিলেন বনে। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে রাখলেও উন্মত্ত মেতেইরা পুলিশের কাছ থেকে তাদের ছিনিয়ে নেয়। এরপর ওই পরিবারের ৫৬ বছর বয়সী এক পুরুষ ব্যক্তিকে খুন করা হয়। তারপর দুই নারীকে নগ্ন করিয়ে হাঁটানো হয়। তাদের দলবদ্ধ ধর্ষণও করা হয় বলে অভিযোগ। পরে পরিবারের তিন নারী কোনো রকমে পালিয়ে যান। ঘটনার দেড় মাস পর ২১ জুন অভিযোগ দায়ের করা হয় পুলিশে। তারও প্রায় এক মাস পরে প্রকাশ্যে এলো গোটা ঘটনা।
এ ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হতেই নিন্দার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে; ওঠে ঘটনায় অভিযুক্তদের দ্রুত শাস্তির দাবিও। এ নিয়ে মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সংসদে বর্ষা মৌসুমের অধিবেশন শুরুর আগে পুরাতন পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই গণতন্ত্রের মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে বলছি, আমার হৃদয় ব্যথা ও ক্রোধে ভরা। যে কোনো সভ্য জাতির জন্য এটি লজ্জাজনক। সারাদেশ এ ঘটনায় লজ্জিত।’
এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ অবিলম্বে কেন্দ্র এবং মণিপুর সরকারের থেকে আজ শুক্রবারের মধ্যে রিপোর্ট তলব করেছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা এ ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিহিংসায় নারীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংবিধানের লাঞ্ছনা চলছে। যে ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে, তা অস্বস্তির। যদি সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, আদালতই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। গণতন্ত্রে এ ধরনের ঘটনা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।’
মণিপুর পুলিশের তরফে জানানো হয়, ওই ভাইরাল ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তাদের চিহ্নিতকরণ ও গ্রেপ্তারে কাজ শুরু হয়েছে। এক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহ বলেছেন, অপরাধীদের প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ডসহ সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এ ইস্যুতে সংসদেও বিরোধীদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়েছে মোদি সরকার। বৃহস্পতিবার দিনের শুরু থেকেই এ প্রসঙ্গে আলোচনার দাবিতে উত্তাল ছিল লোকসভা ও রাজ্যসভা। বিরোধীদের হট্টগোলের জেরে বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনেই মুলতুবি হয়ে যায় সংসদ। রাজ্যসভার সাংসদ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘মণিপুর জ্বলছে। নারীদের দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হচ্ছে। তাদের বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানো হচ্ছে। সব দেখেও প্রধানমন্ত্রী চুপ করে বসে আছেন আর বাইরে বিবৃতি দিচ্ছেন।’
ভাইরাল ভিডিওর প্রতিক্রিয়ায় মোদির সমালোচনা করে বুধবার রাতে টুইটে রাহুল গান্ধী লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা মণিপুরকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে গেছে। ভারত চুপ করে থাকবে না। আমরা মণিপুরের মানুষের পাশে আছি। শান্তিই এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ।’
এবিসিবি/এমআই