ট্রাম্পের গাজা যুদ্ধবিরতি যেভাবে ব্যর্থ হলো

দুই সপ্তাহও হয়নি। রক্ষণশীল পডকাস্টার টাকার কার্লসন সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন কাতারের প্রধানমন্ত্রীর। কঠোর হাতে গাজার যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য উভয়েই উচ্ছ্বসিতভাবে প্রশংসা করছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। সাক্ষাৎকারেই কার্লসন বলেন, ‘ট্রাম্প নির্বাচিত হলেন নভেম্বরে, জানুয়ারিতে হলো অভিষেক। আর সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো।’
জবাবে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-সানি বললেন, ‘আমাকে যে বিষয়টি আসলেই কষ্ট দেয়, সেটা হলো চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি যা অর্জিত হলো, সেটার প্রায় ৯৫ শতাংশই ডিসেম্বর ও মার্চেই হয়ে গিয়েছিল।’
সানি বলেন, ‘আগের (বাইডেন) প্রশাসনের সঙ্গে আমরা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলাম…কিন্তু দিন শেষে…অবশ্যই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প…তারা জানতেন, অভিষেকের আগে কোনো চুক্তি না হলে তার প্রভাব পড়বে।’
তবে মঙ্গলবার ইসরাইল পরিষ্কার করে দিয়েছে, কোনো চুক্তি লঙ্ঘন করলে কিছুই হয় না। আর এর মাধ্যমে সে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের সুনামকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মঙ্গলবার গাজা উপত্যকায় হত্যাযজ্ঞ চালায় ইসরাইল। হত্যা করেছে ৪০০-এর বেশি ফিলিস্তিনিকে।
ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যেই গাজায় হামলা আবার শুরু করার জন্য ইসরাইলকে সবুজ সংকেত দিয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত গাজায় যুদ্ধ আবার শুরুর দায়ভার পুরোপুরি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের ওপর চাপিয়েছেন।
এখন আর কেউ ট্রাম্পের কথা বিশ্বাস করে না
ভয়াবহ মাত্রায় ইসরাইলি হামলার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ইসরাইলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলে যে ধারণাটি ছিল, সেটির অবসান হওয়া। বিশ্লেষকরা এমনটিই মনে করছেন। ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরাইলি বিশেষজ্ঞ মারওয়া মাজিয়াদ মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন, তিনি এখন নগরীর নতুন শেরিফ। নেতানিয়াহু তাকে বিন্দুমাত্র পরোয়া করেননি। এখন আর কেউ ট্রাম্পের কথা বিশ্বাস করে না। এখন তার প্রয়োজন কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’
দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে গাজার যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়েছিলেন-এমন একটি ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করেছিল। যুদ্ধবিরতির পর ট্রাম্প তার আরব মিত্রদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন এই বলে যে, তিনি গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে চান, ফিলিস্তিনিদের জোর করে জর্ডান ও মিসরে পাঠিয়ে দিতে চান।
তার এ বক্তব্য বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। আরব নেতাদের পাশাপাশি মার্কিন কর্মকর্তারা পর্যন্ত মনে করতে থাকেন যে, এটা আসলে ট্রাম্পের একটি চালাকি। তিনি এর মাধ্যমে গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনে পালটা একটি আরব পরিকল্পনা সামনে আনার জন্য তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। তবে পরিকল্পনাটি নিয়ে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। ট্রাম্পের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করা এবং গাজা জয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ নেই।
তবে ট্রাম্পের বক্তব্যে তার জামাতা ও সাবেক উপদেষ্টা জারেড কুশনারের চিন্তাধারার মিল দেখা গেছে। কুশনার এবং তার ঘনিষ্ঠরা কিন্তু উপত্যকাকে ‘গাজা রিভেরা’য় পরিণত করতে এবং ফিলিস্তিনিদের মিসরে পাঠাতে অনেক দিন ধরেই পরিকল্পনা করছেন।
যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পরিকল্পনা
ট্রাম্প যাতে তার আইডিয়াটি থেকে সরে যান, সে উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। তিনি ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউজ সফর করে ওভাল অফিসে প্রকাশ্যে ট্রাম্পের প্রশংসা করলেও একান্ত আলাপে তাকে জানিয়ে দেন, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হলে ‘ইসলামি চরমপন্থায়’ ইন্ধন দেওয়া হবে। ওই সফরের পর আরব দেশগুলো যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করে। এ কাজে নেতৃত্ব দেয় মিসর। এর কারণ হলো, আগের যুদ্ধগুলোর পর গাজা পুনর্গঠনে তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। মিসরীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়েছে হামাস নেতাদের সম্পর্ক। মিসর গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনে ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে উপত্যকাটি পরিচালনা করতে আহ্বান জানানো হয়, জর্ডান ও মিসরের প্রশিক্ষণে নতুন একটি নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের কথাও বলা হয়। এতে গাজা উপত্যকায় নতুন একটি বন্দর ও একটি বিমানবন্দর নির্মাণের প্রস্তাবও রয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ইঙ্গিতও রয়েছে।
তবে ইসরাইল এ প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দেয়। ট্রাম্প প্রশাসন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করেন। তবে আরব কর্মকর্তারা দেখতে পান, ট্রাম্পের আস্থাভাজন উইটকফের সুর অনেকটাই নমনীয়। তিনি বলেছিলেন, পরিকল্পনাটি ‘পুনঃনির্মাণ পরিকল্পনার ভিত্তি’ হতে পারে। এরপর ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেন, পরিকল্পনাটি প্রকাশের পর কোনো ফিলিস্তিনিকে গাজা উপত্যকা থেকে বহিষ্কার করা হবে না।
মার্চে রমজানের শুরুতে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ত্রাণ সরবরাহ কমিয়ে দিতে শুরু করে। তারপর উপত্যকায় বিদ্যুৎ কমিয়ে দেয়। এরপর শুরু হলো হামলা।
যুক্তরাষ্ট্র-হামাস আলোচনা ও পিছু হটা
গাজা উপত্যকায় একতরফাভাবে হামলা শুরু করার ইসরাইলি সিদ্ধান্ত ছিল বিদ্যমান অনিশ্চয়তার ফসল। জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপটি কয়েক সপ্তাহ আগে শেষ হলেও ইসরাইল দ্বিতীয় ধাপে যেতে চায়নি। উইটকফ ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিনিময়ে গাজার বন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে নেতানিয়াহুকে রাজি করানোর চেষ্টা করলেও তাতে খুব বেশি সফল হননি।
এদিকে হামাসের ওপর চাপ বাড়িয়ে তাদেরকে সমঝোতায় রাজি করানোর চেষ্টাও করেন ট্রাম্প। অবশিষ্ট বন্দিকে মুক্তি না দিলে হামাসকে নির্মূল করা হবে বলেও হুমকি দেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি কাতারে হামাসের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য নিজের ঘনিষ্ঠ অ্যাডাম বোয়েলারকে দায়িত্ব দেন। বিষয়টি ইসরাইলি মিডিয়া ফাঁস করে দিলে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের ডানপন্থি সমর্থকদের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়। তবে হোয়াইট হাউজ জানায়, বোয়েলার আসলে অবশিষ্ট এক মার্কিন বন্দির মুক্তির জন্য আলোচনা করছে। অবশ্য, ওই দূত প্রকাশ্যে জানান, তিনি হামাসের সঙ্গে ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনায় হামাসের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এবং গাজাকে অসামরিকরণের বিষয়ও ছিল। তিনি জানান, আলোচনা হয়েছে ইতিবাচকভাবে। কিন্তু শুক্রবার বোয়েলারকে আলোচনা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
আরব রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব
গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহহীনতা এবং হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসরাইল এখন যুদ্ধ শুরু করেছে। আর গাজায় বোমা হামলা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা পাচ্ছেন নেতানিয়াহু। এরই মধ্যে নেতানিয়াহুর চরমপন্থি সাবেক মিত্র ইতামার বেন-গভির জানিয়েছেন, তিনি আবার সরকারে যোগ দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, তিনি জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির পর পদত্যাগ করেছিলেন।
ইসরাইল-বিশেষজ্ঞ মারওয়া মাজিয়াদ বলেন, ইসরাইলি হামলা ‘আরব রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে মিসর, কাতার ও সৌদি আরবের এ ব্যর্থতাই প্রকাশ করে দিচ্ছে যে, তারা ট্রাম্পকে বোঝাতে পারেননি নেতানিয়াহু আসলে তার লক্ষ্যকেই বানচাল করে দিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প পারতেন নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে। প্রশ্ন হলো, আরব রাষ্ট্রগুলো কেন তা পারেনি? আমার মনে হচ্ছে, এটি আসলে ইচ্ছার অভাব।’
মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ
সিন ম্যাথুস : মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যবিষয়ক সাংবাদিক