২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা : ছোটদের বরাদ্দ কাড়ছে বড়রা

দেশের তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা সরকারের করোনাকালীন প্রণোদনা থেকে ১৫ কোটি টাকা নিয়েছেন। এই অর্থ তিনি ঋণ নিয়েছেন বৃহৎ শিল্পের জন্য বরাদ্দ ৩০ হাজার কোটি টাকা থেকে। একই মালিকের আরেকটি মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সরকার কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এই উদ্যোক্তার মাঝারি প্রতিষ্ঠানের নামেও ১০ কোটি টাকা নিয়েছেন এই সিএমএসএমই খাতের প্রণোদনার অর্থ থেকে। এভাবে বড় শিল্প মালিকরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আহার কেড়ে নিচ্ছে। শুধু এই একটি প্রতিষ্ঠান নয়, একই ধরনের কাজ করেছেন আরও কয়েকজন বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকও।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি সম্পূর্ণ নীতিহীন একটি কাজ। যে উদ্যোক্তারা এ ধরনের কাজ করছেন তারা যেমন অপরাধী, ঠিক একই রকম অপরাধ করছে ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বড় উদ্যোক্তারা যদি এ ধরনের কাজ করে থাকে তা হলে সেটি হবে অনৈতিক কাজ। অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখা উচিত এখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না। এই প্রণোদনার অর্থ তাদেরই প্রাপ্য যারা সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তা।
তিনি আরও বলেন, তবে অনিয়ম হতেই পারে, বাংলাদেশে সেটা অসম্ভব নয়। যদি অনিয়ম হয়ে থাকে তা হলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের সেটি তদারকি করা উচিত। কারণ কোনো ঋণ দিতে গেলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। সুতরাং কোনো ব্যাংক যদি এটা করে থাকে তা হলে সেটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দুই দফা সময় বাড়ানোর পরও সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঋণ বিতরণ করা সম্ভব না হওয়ায় আরও এক দফা সময় বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগ জানায়, এ সুযোগ শুধু প্রণোদনার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের ঋণ বা বিনিয়োগ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল।
যেসব ব্যাংক প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে প্যাকেজের ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি, তাদের ৩১ মার্চ ২০২১-এর মধ্যে তা নিশ্চিত করতে একটি মাসভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে আগামী ১৭ জানুয়ারির মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
অন্যদিকে সরকার সিএমএসএমই খাতের জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্ধেক বা ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ এখনও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ বাকি রয়েছে। অথচ বৃহৎ খাতের জন্য যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় তার পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে ডিসেম্বরের আগেই।
তা হলে সিএমএসএমই খাতের জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এখনও কেন ১০ হাজার কোটি টাকা পড়ে রইল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর পেছনে বড় কারণ রয়েছে তিনটি। প্রথমত, অনেক ব্যাংকের সিএসএমই ঋণ বিতরণের সক্ষমতা নেই। যেসব ব্যাংকের এ সক্ষমতা নেই তাদেরকেও সিএসএমই ঋণ বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মূলত এসব ব্যাংকের ব্যর্থতার কারণেই প্রণোদনার অর্থ বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, সব ব্যাংকের এসএমই ঋণে দেওয়ার মতো ব্যবস্থাপনা নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে অনেক ব্যাংকের সক্ষমতাই নেই এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার। দিতে পারলে তো তারা দিয়েই দিত। আসলে এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরও বর্তায়। সব ব্যাংক তো আর সমানভাবে এসএমই ফোকাসড নয়। অনেক ব্যাংক আছে শুধু রফতানিকে প্রাধান্য দেয়, কোনো ব্যাংক শুধু করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাধান্য দেয়, কোনো ব্যাংক আবাসন খাতকে প্রাধান্য দেয়, আবার কোনো ব্যাংক কৃষিকে প্রাধান্য দেয়।
তার মতে, কোনো ব্যাংক যদি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দেয়, সে ব্যাংককে যদি সিএমএসএমইর ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়, তা হলে তো সে ব্যাংক এগুলো বিতরণ করতে পারবে না। এসব ব্যাংকের দুর্বলতার কারণেই বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যালোকেশন পলিসির দুর্বলতাকেই আমি দায়ী করব। বাংলাদেশ ব্যাংক অথরাইজেশন লেটারটা পরিবর্তন করে বিতরণে ব্যর্থ ব্যাংক থেকে নিয়ে সফল ব্যাংকে দিলেই সমস্যাটা মিটে যায়। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক কলমের এক খোঁচায় পরিবর্তন করতে পারে। যে ব্যাংক গত ৬ মাসে বিতরণ করতে পারেনি, সে আরও ৬ মাসেও পারবে না। অযথা সময় নষ্ট করে কি লাভ।
তিনি বলেন, যেমন ব্র্যাক ব্যাংক, আইডিএলসি নভেম্বরের মধ্যেই তাদের জন্য বরাদ্দ সিএমএসএমইর ঋণ দেওয়া সম্পন্ন করেছে। পরে ব্র্যাক ব্যাংকে আরও ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বিতরণের জন্য, সে অর্থও প্রায় দেওয়া শেষ। প্রথমে সর্বোচ্চ ১১শ কোটি টাকা দেওয়া হয় ব্র্যাক ব্যাংককে। যাদের সক্ষমতা আছে তারা বিরতণ করতে পেরেছে, যাদের সক্ষমতা নেই তারা পারছে না। তিনি জানান, ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ প্রণোদনার ঋণ। এখনও ১০ হাজার কোটি টাকা পড়ে আছে। এই অর্ধেক অর্থ পড়ে আছে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার কারণে। আমার জানা মতে ১৫-২০টি ব্যাংক সিএসএমইর প্রণোদনার অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তা ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মাঝে প্রণোদনার অর্থ বিতরণে সমস্যা- অনেক উদ্যোক্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, কারও হয়তো মর্টগেজ দেওয়ার মতো কোনো সম্পত্তি নেই। আবার ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় লবিং বা তদবিরেরও দরকার হয়- তাদের সে রকম কোনো লাইন-ঘাটও নেই। এসব ছোটখাট কিছু বিষয়ও আছে সিএমএসএমই খাতের প্রণোদনার অর্থ বিতরণে।
আরেক অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বড় উদ্যোক্তারা যদি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার অর্থও নিয়ে থাকেন তা হলে আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে তারা কিছুটা চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ নেওয়ার পর একই মালিকের ছোট বা মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে- সে প্রতিষ্ঠানের নামে সিএমএসএমই ফান্ড থেকে ঋণ নিয়েছেন। এটা হওয়া কোনোভাবেই উচিত না। বড়দের ছোট প্রতিষ্ঠান থাকতেই পারে, তাই বলে বড়রা তার ছোট প্রতিষ্ঠানের জন্য এভাবে অর্থ নিতে পারেন না। আমি বলব- এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দায় বেশি। কারণ ব্যাংকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম দেখে ঋণ দেয়। সুতরাং একই মালিক কীভাবে প্রণোদনার অর্থ তার দুই প্রতিষ্ঠানের নামে নিতে পারে। এটি আইনগতভাবেই নৈতিক নয়, পুরোপুরি অনৈতিক কাজ।