২০ লাখ টিকা পাঠাচ্ছে ভারত : পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে শঙ্কা

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা ব্যবহারের তালিকায় প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে একের পর এক দেশের নাম। অধীর অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশের মানুষও। সেই অপেক্ষা শেষ হচ্ছে। আজ-কালের মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছবে ২০ লাখ ডোজ টিকা, যা ভারত সরকার উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকার এই ২০ লাখ ডোজ সরকারের কেনা তিন কোটি ডোজের অতিরিক্ত।
সরকারিভাবে টিকার তিন কোটি ডোজ কেনা হয়েছে, যার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ টিকা ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে পৌঁছবে। উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া এ ভ্যাকসিনে সব ধরনের কর মওকুফ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। টিকা প্রাপ্তির এই নিশ্চয়তার মধ্যেই এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রয়োগে অনীহা প্রকাশ করছেন অনেকে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক প্লাটফর্মে ভ্যাকসিন নিয়ে সরব রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশা ও বয়সের মানুষ।
যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ও যাদের অন্য একাধিক ওষুধ খেতে হয় তাদের ভ্যাকসিন নিতে নিরুৎসাহিত করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রধানত, যেসব ক্যানসারে আক্রান্ত কেমোথেরাপিতে রয়েছেন, যাদের এইচআইভি পজিটিভ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে করোনার টিকার প্রয়োগ ক্ষমতা অত্যধিক রকমের কম থাকতে পারে। যাদের শরীরে রক্তপাতজনিত সমস্যা রয়েছে, তারাও যেন করোনার টিকা এড়িয়ে যান। যারা অত্যন্ত অসুস্থ, কিংবা কোনো অ্যালার্জির ইতিহাস রয়েছে যাদের, অথবা অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও করোনার টিকা এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলছেন।
অন্যদিকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনে ভরসা করতে পারছে না খোদ ভারতীয়রাই। দেশটিতে সরকারের আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে যায়নি। গত শনিবার থেকে ভারতে শুরু হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচি। দেশটিতে তিন হাজারের মতো কেন্দ্রে একসঙ্গে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর প্রথম তিন দিনে অন্তত ৫৮০ জনের শরীরে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা জানিয়েছে ভারত সরকার। এ ছাড়া মারা গেছেন দুজন।
তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলছেন, করোনাকালেও বিরোধীরা সবসময় শুধু সমালোচনা করেছে। এখন তারা ভ্যাকসিনের সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত। প্রতিটি ভ্যাকসিনের কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এমনকি ওষুধেরও কোনো না কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের যথেষ্ট প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। তিনি আরও বলেন, অন্যের সমালোচনায় কান দেওয়ার দরকার নেই। আমরা কার্যকর করোনা ভ্যাকসিন আনছি এবং এ ভ্যাকসিন দেশের সবাই পাবে।
করোনাভাইরাসের টিকার চালান হাতে পাওয়ার পর প্রতিদিন দুই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়া হবে। মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা কর্মীরাই আগে টিকা পাবেন, ভিভিআইপিদের জন্য এখানে কোনো অগ্রাধিকার নেই। ভারত থেকে আসা টিকার ব্যবস্থাপনা নিয়ে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরে এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, আমাদের যে শিডিউল আছে, সে অনুযায়ী আসবে। আগামীকালের (আজ বুধবার) একটা শিডিউল আছে, অথবা পরশু দিন আসবে। এটাই সবশেষ খবর। ভারত এই টিকা আমাদের কাছে পৌঁছে দেবে। বিমানবন্দরে গিয়ে টিকা গ্রহণ করব। সব কিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে মাঠ পর্যায়ে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে জন্য আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকেই অনলাইনে নিবন্ধন শুরু করার কথা ছিল। এখন ভারতের উপহারের টিকা আগে চলে এলে সময়সূচিতে পরিবর্তন আসবে।
জাহিদ মালেক বলেন, টিকা আগে চলে এলে প্রয়োগও আগে হবে। যেটা আমাদের ভারত সরকার দিচ্ছে সেটা যদি আগে পেয়ে যাই, তা হলে আমাদের কার্যক্রম কিছুটা আগেই শুরু করব। সারা দেশে পৌঁছুতে কিছুটা সময় লাগবে। সব জায়গায় পৌঁছলে আমরা সারা দেশে একযোগে কাজ শুরু করব। শুরু হবে ঢাকা থেকে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, জেলা পর্যায়ে চারটি, উপজেলায় দুটি এবং মেডিকেল কলেজে ছয়টি দল টিকা দেওয়ার কাজ করবে। কয়েকটি দল কাজ করবে বিভিন্ন হাসপাতাল এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রায় ২৮ হাজার ভলান্টিয়ার এই কাজে যুক্ত থাকবে। প্রাথমিকভাবে আমরা ইউনিয়নগুলো বাদ দেব। শুধু জেলা, উপজেলা এবং সিটি করপোরেশন এলাকা হিসাব করে প্রতিদিন আনুমানিক দুই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী শুরুতেই টিকা নিচ্ছেন- বাংলাদেশে এমন কিছু হবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, যাদের সবচেয়ে আগে প্রয়োজন, ফ্রন্টলাইনার, তাদের আগে দেব। ডাক্তার, নার্স ও পুলিশ প্রথমে আমরা সাংবাদিকদেরও দেব। যেটা প্ল্যান করা আছে, সেভাবেই হবে। ভিভিআইপি আমাদের জন্য পুরো দেশের মানুষই ভিভিআইপি, আমরা সেভাবেই দেখি। যাদের প্রয়োজন আগে তাদের আগে দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এবিএম খুরশীদ আলম এর আগে সাংবাদিকদের বলেন, ভারত উপহার হিসেবে করোনাভাইরাসের যে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠাচ্ছে, তা বুধবারই বাংলাদেশে পৌঁছবে। ভারত থেকে টিকা আসার পর তা স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিএমএসডি, ইপিআই এবং তেজগাঁও হেলথ কমপ্লেক্সের কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা হবে। টিকার প্রথম চালান হাতে পাওয়ার পর সব জেলায় একসঙ্গে গণ টিকাদান কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের কিছু টিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এক সপ্তাহ পর সব জেলায় শুরু করা হবে।
উপহার হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া এ ভ্যাকসিনে সব ধরনের কর মওকুফ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশেষ বিমানযোগে ২০ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসবে। এ ভ্যাকসিনের ওপর সব ধরনের কর মওকুফ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব তৌহিদ ইমাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি এনবিআর চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে উপহারস্বরূপ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ডোজ করোনা টিকা সরবরাহ করবে। টিকার চালানটি এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমানযোগে ২০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে ও জনস্বার্থ বিবেচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকারের পাঠানো ২০ লাখ ডোজ টিকার চালানের ওপর সব ধরনের কর, শুল্ক ও অন্যান্য শুল্ক মওকুফ করে দ্রুত ছাড় করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ভ্যাকসিনের বাহন ও সংরক্ষণের বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে ভারতীয় হাইকমিশন। এই টিকা বিমানবন্দর থেকে পরিবহনের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাক ও ভ্যান এবং সংরক্ষণের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে ভারতীয় হাইকমিশন। এই টিকা পরিবহনের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাক-ভ্যান সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (জনসংখ্যা-২) সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান মোল্লা স্বাক্ষরিত একটি চিঠি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকার করোনা মোকাবিলায় জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে জাতীয় ভ্যাকসিন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ভারত সরকার বাংলাদেশকে সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রস্তুতকৃত ২০ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দেবে। এই ভ্যাকসিনের চালানটি ভারতের একটি বিশেষ ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। এতে আরও বলা হয়, বিমানবন্দন থেকে ভ্যাকসিন পরিবহনের যেসব বাহন (ট্রাক-ভ্যান) ব্যবহার করা হবে তার বিস্তারিত বিবরণ ভারতীয় হাইকমিশন থেকে চাওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে ভ্যাকসিন পরিবহনে যেসব ট্রাক-ভ্যান ব্যবহার করা হবে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন জরুরি ভিত্তিতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হলো।
অন্যদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের পাঠানো সেই চিঠিতে কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে তারা যানবাহনের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। ভ্যাকসিনের ইমপোর্ট লাইসেন্স ইস্যু করা, বাংলাদেশ কীভাবে ভ্যাকসিনটি গ্রহণ করবে, কাস্টমসে শুল্ক ছাড়, ভ্যাকসিন টেস্ট না করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিমানবন্দরের কাছাকাছি ভ্যাকসিন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা এবং সংরক্ষণের জায়গাটির অবশ্যই ২ থেকে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা নিশ্চিত করতে হবে বলেও চিঠিতে জানানো হয়েছে।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। তা সোয়া ৫ লাখ পেরিয়ে যায় গত ১৪ জানুয়ারি। এর মধ্যে গতবছরের ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনে শনাক্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর গতবছরের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু হয়। ২৯ ডিসেম্বর তা সাড়ে সাত হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে গত বছরের ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যু হয়, যা এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। বিশ্বে শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৯ কোটি ৫৬ হাজার পেরিয়েছে। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২০ লাখ ৪১ হাজার।
দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ৭ হাজার ৯৪২ জনের মধ্যে ৬ হাজার ১৮ জনই পুরুষ এবং ১ হাজার ৯২৪ জন নারী। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৩৮১ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। এ ছাড়া ১ হাজার ৯৯৯ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ৯১৪ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, ৩৯১ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, ১৬১ জনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ৬০ জনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ও ৩৬ জনের বয়স ছিল ১০ বছরের কম। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪০৬ জন ঢাকা বিভাগের, ১ হাজার ৪৫৭ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৪৫৪ জন রাজশাহী বিভাগের, ৫৪৪ জন খুলনা বিভাগের, ২৪০ জন বরিশাল বিভাগের, ৩০১ জন সিলেট বিভাগের, ৩৫৪ জন রংপুর বিভাগের ও ১৮৬ জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।