সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিতে পারে আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন ওপেক-প্লাস। গত সপ্তাহে ওপেক-প্লাস ঘোষণা দেয় যে, তারা দৈনিক উৎপাদন ২০ লাখ ব্যারেল কমাবে। এর আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এমন পদক্ষেপ না নেওয়ার আহবান জানিয়ে আসছিল। কারণ উৎপাদন কমালে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়বে। আর এর মাধ্যমে সুবিধা পাবে রাশিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি সৌদি আরব।
ওপেক-প্লাসের এই সিদ্ধান্তের জন্য সৌদি আরবকে দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজ বলেছে, সৌদি আরব অন্যান্য ওপেক সদস্যদের তেল কমানোর ব্যাপারে ভোট দিতে চাপ প্রয়োগ করেছে। এর মাধ্যমে সৌদি আরব রাশিয়ার আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। সৌদি আরবকে এই পদক্ষেপের জন্য পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত সপ্তাহে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব সম্পর্কে প্রভাব পড়বে। তবে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ঠিক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তিনি ভাবছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।
হোয়াইট হাউজ এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সৌদি আরবকে শাস্তি দিতে চাইছে। অনেকগুলো পদক্ষেপের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, এসব কঠোর পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আট দশকের অংশীদারিত্ব গুরুতরভাবে ভেঙে পড়তে পারে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে? বাইডেন প্রশাসনের সামনে বিকল্পগুলো কী আছে?
সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথমত যুক্তরাষ্ট্র নোপেক বিল পাশ করতে পারে। তেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, হোয়াইট হাউজ বলেছিল যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন জ্বালানির দামের ওপর ওপেকের নিয়ন্ত্রণ কমাতে কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। যা দ্বিদলীয় নোপেক বিলকে সমর্থন করার হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছিলো।
বিলটির উদ্দেশ্য হলো—অনাস্থা আইনের মাধ্যমে তেলের দামের ওপর ওপেক রাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ ভেঙে ফেলা। বিলটি পাস হলে ওপেক সদস্য দেশ এবং তাদের তেল কোম্পানিগুলোর ওপর থেকে সুরক্ষা তুলে নেওয়া হবে এবং দাম বাড়ানোর জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। গত মে মাসে মার্কিন সিনেটের একটি কমিটি বিলটি পাশ করে। কিন্তু আইন হওয়ার জন্য, এটি এখনও সম্পূর্ণ সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে পাশ হতে হবে এবং প্রেসিডেন্টকে সই করতে হবে। মর্নিং কনসাল্ট অ্যান্ড পলিটিকোর একটি জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন ভোটারদের অর্ধেকেরও কম নোপেক বিলকে সমর্থন করবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিল পাশ হলে যুক্তরাষ্ট্রকেও কিছু ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার অন গ্লোবাল এনার্জি পলিসির সিনিয়র রিসার্চ স্কলার কারেন ইয়ং বলেন, এটি তেল ও গ্যাস শিল্পের অনেক অংশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সৌদি আরব তেল উত্পাদনে সবচেয়ে কম খরচ করে, তাই তেলের কম দামেও তারা মুনাফা করতে পারবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্পের সমিতি আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট বিলটির বিরোধিতা করেছে। তারা বলেছে, এই বিল মার্কিন কূটনৈতিক, সামরিক এবং ব্যাবসায়িক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হবে।
দ্বিতীয়ত, সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারে। কয়েক দিন আগেই মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান বব মেনেনডেজ অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও অনেক রাজনীতিক এতে সমর্থন দিয়েছেন, কিন্তু অনেকেই আবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে কেবল সৌদি আরবকে আরো রাশিয়ার অস্ত্রের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। ২০২১ অর্থ বছরে তারা বিভিন্ন দেশের কাছে গড়ে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের মূল অস্ত্র ক্রেতা দেশ। এ কারণে ইয়াং মনে করেন, সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় অন্য সরবরাহকারী দেশের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।
তৃতীয়ত, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। গত সপ্তাহে তিনজন ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সেনা প্রত্যাহারে একটি বিল উত্থাপন করেন। বিলে বলা হয়েছে, উভয় দেশই তাদের নিরাপত্তা ও তেলক্ষেত্র রক্ষার জন্য উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। যারা আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে সেখানে সেনা রাখার কোনো কারণ নেই। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা কম। কারণ এর ফলে ওই অঞ্চলে শূন্যতা তৈরি হবে, যা ইরান, চীন এবং রাশিয়ার মতো মার্কিন প্রতিপক্ষরা পূরণ করতে পারে।
সৌদি আরবকে শাস্তি দেওয়ার আর কী বিকল্প আছে? নিয়ার ইস্ট সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের একজন অধ্যাপক এবং পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা ডেভিড ডেস রোচেস বলেন, বর্তমান অবস্থায় সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করা যেতে পারে। কাজ নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেতে পারে। যদিও তিনি বলেন, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের দিন থেকে এই সম্পর্ক নিরবচ্ছিন্ন হওয়ার একটি কারণ রয়েছে, এই সম্পর্ক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং সেই স্বার্থ এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে।
এবিসিবি/এমআই