শেখ হাসিনার পরিণতি থেকে কি দিল্লি শিক্ষা নেবে

বিষয়টা কাকতলীয়ই বটে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে উড়াল দিতে বাধ্য হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০২৯ সালের পরও অবশ্যম্ভাবীভাবে বহাল থাকার কথা বলছিলেন। শেখ হাসিনা ঠিক যেভাবে তাঁর অপরিহার্যতার কথা বিশ্বাস করতেন, ঠিক সেভাবেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ডান হাত নিজেকে তো বটেই, সম্ভবত তাঁর নেতাকেও এটা বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন যে মোদি হাল ধরে না থাকলে ভারত ধ্বংস হয়ে যাবে।
গত রোববার চণ্ডীগড়ে এক সমাবেশে অমিত শাহ বলেন, ‘বিরোধীরা যা ইচ্ছা, তা বলতে পারে। তবে আমি এটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি যে ২০২৯ সালে প্রধানমন্ত্রী আবার ক্ষমতায় আসবেন।’ কতটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবি, ভাবা যায়!
অবশ্যই ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রাথমিক লক্ষ্য হলো সব গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অংশীজনকে এই বার্তা দেওয়া যে দুই মাস আগে লোকসভা নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা মোদির শাসনকে তিরস্কার করলেও তা গুরুত্বসহকারে না নেওয়া।আরও পড়ুন
সম্প্রতি শেখ হাসিনা ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন এমন একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে, যার গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি ছিল। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনপ্রক্রিয়া বর্জন করে। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের কোনো ভানও করা হয়নি।
আমাদের নিজ দেশে অনেকে মনে করেছিলেন যে নির্বাচন কমিশনের ওপর মোদি সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিজেপি-বিরোধী দলগুলোর ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে দূরে থাকা উচিত হবে। তবে নির্বাচনী বন্ড নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ফলে নিন্দুকেরা সার্বিকভাবে সংবিধানের ওপর কিছু বিশ্বাস ফিরে পান। তারপরও নির্বাচন কমিশন সবার কাছ থেকে নিঃশর্ত মর্যাদা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এ (আগস্ট ৫ ২০২৪) সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার সরকার সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এই সরকার একটা মিথ্যা রচনার কারখানা, যারা ক্রমাগত মিথ্যা, মিথ্যা ও মিথ্যা বলে গেছে এবং নিজেদের রচিত মিথ্যা বিশ্বাস করতেও শুরু করেছে।’ প্রতিটি নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে এই জোরাজুরি দেখা যায়।
তথ্য ও পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে মোদির সরকারের আচরণে একই ধরনের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। এরা সব আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও মতামত প্রত্যাখ্যান করেছে; এমনকি গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য পরিমাপের সব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও মাপকাঠি নাকচ করে দিয়েছে।
শেখ হাসিনার ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিগত শাসন আদলের পরিণতি থেকে যথাযথ শিক্ষা নেওয়ার মতো প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা আমাদের এখানে অমিত শাহ ও জে পি নাড্ডার আছে বলে কেউ মনে করে না। তবে যে কেউই আস্থাবান হতে পারে যে ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবার তাদের শক্তি অর্জন করবে এবং মোদি সরকারের নিরাময় না হওয়া সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। ঢাকার পরিণতি নয়াদিল্লিতে পুনরাবৃত্তি হওয়ার কোনো দরকার নেই।
নাগরিক সমাজ ও তাদের সমালোচনাকে এই বলে নাকচ করেছে যে তারা আসলে ভারতমাতার বদনামকারী এবং দেশের স্থিতিশীলতা বিনাশ করতে চায়। এখন মুখের ওপর ভোটারদের চপেটাঘাত খেয়েও তা হজম করতে পারছে না। আর তাই মোদির লোকলস্করেরা ডিজিটাল মাধ্যমে সব মুক্তকণ্ঠ রুদ্ধ করতে চাইছে।
গত ১০ বছরে এটা যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে গেছে যে জাতীয় শাসনের সমস্যা ও জটিলতা নিরসনে নরেন্দ্র মোদির প্রকল্প কোনো সমাধান দিতে পারেনি। আত্মপ্রশংসা ও আত্মপ্রচারণা বাদ দিলে মোদির এক দশকের সরকার অদক্ষতা, অসংবেদনশীলতা ও অক্ষমতায় ভরপুর। আর তা হয়েছে এ জন্য যে একটা বিভ্রান্তকর ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ জায়গা থেকে দাবি করা হয়েছিল যে একজন সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত কান্ডারি ‘ভঙ্গুর’ ব্যবস্থা মেরামত করতে পারে।
বাংলাদেশের ঘটনা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যে দাবিই করুন না কেন, গণতন্ত্র কখনো রাজা বা সম্রাটকে নির্বাচিত করে না। গণতন্ত্র বেছে নেয় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিকে এবং তা সংবিধানপ্রদত্ত বৈধতা থেকে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকার মানে হলো জবাবদিহিমূলক সরকার। বিজেপি ও আরএসএস যদি মনে করে যে তারা সংবিধানিক প্রক্রিয়াকে অপব্যবহারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিকৃতি ঘটাতে পারবে, তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবে।
শেখ হাসিনার ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিগত শাসন আদলের পরিণতি থেকে যথাযথ শিক্ষা নেওয়ার মতো প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা আমাদের এখানে অমিত শাহ ও জে পি নাড্ডার আছে বলে কেউ মনে করে না। তবে যে কেউই আস্থাবান হতে পারে যে ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবার তাদের শক্তি অর্জন করবে এবং মোদি সরকারের নিরাময় না হওয়া সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। ঢাকার পরিণতি নয়াদিল্লিতে পুনরাবৃত্তি হওয়ার কোনো দরকার নেই।
হরিশ খারে ভারতীয় সাংবাদিক। ২০০৯-১২ সময়কালে প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম উপদেষ্টা ছিলেন। দ্য ওয়ার ডট ইনে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজ থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া