ডলার সংকট: আইএমএফের কাছে কেন ঋণ চাইছে বাংলাদেশের সরকার?

রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে বাংলাদেশের সরকার চিঠি পাঠিয়েছে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছে চারশো কোটির বেশি ডলার ঋণ চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেকটা বাধ্য হয়েই আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
গত রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে বাংলাদেশের সরকার চিঠি পাঠিয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ”ক্রেডিটরস রেজিলিয়্যান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্ট” থেকে ঋণ পাবার জন্য আলোচনার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ৪১৬ কোটি ডলার সহায়তার অনুরোধ জানিয়েছে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES
তবে আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ কতো ডলার ঋণ চেয়েছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাননি কোন কর্মকর্তা। তবে বাংলাদেশের ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলি স্টার অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, তিন বছরে ৪৫০ কোটি ডলার চাইছে বাংলাদেশ।
এর আগে কয়েকবার আইএমএফ থেকে ঋণ সহায়তা নিয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু এর পরিমাণ কোনো বারই ১০০ কোটি ডলার পেরোয়নি।
বুধবার ঢাকায় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির একটি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ”আমরা অর্থ চাইবো বলেছি, কতো লাগবে সেটা বলি নাই। তারা কী শর্তে সেটা দিতে চাইবে, আমরা সেটা দেখবো।”
“তারা যদি পজিটিভলি দিতে চায় এবং আমরা কম রেটে পাই, তাহলে ইন দ্যাট কেইস, আমরা বিবেচনা করতে পারি।”
কিন্তু কেন আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানের কাছে বিপুল অংকের ঋণের জন্য দ্বারস্থ হলো বাংলাদেশ?
‘বাধ্য হয়েই আইএমএফের কাছে গেছে বাংলাদেশ’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাস, যন্ত্র ও পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। সেই চাপ সামলাতেই আইএমএফ দাতা সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES
গত বছর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫.৫ বিলিয়ন থাকলেও জুলাই মাসের ২০ তারিখ নাগাদ সেটা ৩৭.৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি অনেক বেড়েছে। ফলে দেশীয় বাজারে ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”আমরা দেখতে পেয়েছি, সাম্প্রতিক সময়ে ফরেন এক্সচেঞ্জের একটি বড় ধরনের সরবরাহ ঘাটতি আছে বাংলাদেশে এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর যথেষ্ট প্রেশার আছে। সেই চাপ একটু কমানোর জন্য সরকার এখন আইএমএফর কাছে গেছে।”
জুলাই ২০২১ থেকে মে ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি তৈরি হয়েছে ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন, যা আগের বছরের ওই সময়ে ছিল মাত্র ২.৭৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের কাছে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশের সরকার বলেছেন, আগের বছরের তুলনায় এই সময়ে আমদানি বেড়েছে ৩৯ শতাংশ।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES
ড. সেলিম রায়হান বলছেন, ”গত এক দশক ধরে ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়নি বাংলাদেশ। কারণ এই সময়ে রেমিটেন্স এবং রপ্তানি – দুটোই কম বেশি ভালো করেছে। কিন্তু এখন বিশ্বে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার কারণে রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রপ্তানি ভালো হলেও আমদানি যে হারে বেড়েছে তাতে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে একটা চাপ তৈরি করেছে।”
”সরকার বুঝতে পারছে যে, অন্য সোর্স থেকে ডলার সরবরাহ বাড়িয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয় এই মুহূর্তে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে গেছে,” তিনি বলছেন।
আইএমএফের কাছে ঋণের অনুরোধ জানিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানও। সর্বশেষ এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২০ সালে ৭৩.২ কোটি ডলার ঋণ বরাদ্দ দিয়েছিল আইএমএফ।
আইএমএফ ঋণ প্রসঙ্গে যা বলছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা
রবিবার আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে চিঠি পাঠানো হলেও বুধবার সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের পর মুখ খুলতে শুরু করেন সরকারি কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন ”অর্থের দরকার পড়লে কে দেবে? আমরা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকি। দেশে গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলো শেষ করতে অর্থের দরকার।”
“আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) – সবার কাছ থেকেই স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া হয়। ঋণগুলো নেয়া হয় সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে”।
”এবার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, হচ্ছে এবং আরও হবে। লেনদেনের ভারসাম্য ও বাজেট সহায়তা বাবদ ঋণ পেতে একটা আনুষ্ঠানিক আলোচনা যাতে শুরু করে, সেজন্য আইএমএফকে অনুরোধ করা হয়। আশা করছি, আইএমএফ এ ব্যাপারে একটা মিশন নিয়ে আসবে,” – প্রথম আলোকে বলেন অর্থমন্ত্রী।
তবে পুরো ঋণ প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ বলে তিনি জানিয়েছেন। কবে নাগাদ এই ঋণ পাওয়া যাবে এবং কত টাকা কী শর্তে পাওয়া যাবে- সেসব পরবর্তীতে পরিষ্কার হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বুধবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস এই ঋণের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ”সাধারণত আইএমএফের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত বৈঠক চলে। সেখানে চার ধরনের ফান্ডিং অপরচুনিটি আছে, যেগুলো আমরা ব্যবহার করি। এগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিবছরই আলোচনা চলে। ”
”এখন যেহেতু আমাদের আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে একটা পার্থক্য হয়েছে, আমাদের ব্যাল্যান্স অব পেমেন্টে একটা ঘাটতি হতে পারে, সেজন্য ‘এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি’ হিসাবে ঋণ চাওয়া হয়েছে। এটা কোন অনুদান না, ফ্রি কিছু না, এটা একটা ঋণ। ফেভারেবল কন্ডিশনে, সহজ শর্তে ঋণ,” তিনি বলছেন ।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে, তাতে এখন ছয় মাসের বেশি পণ্য আমদানির রিজার্ভ রয়েছে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দাবি করেন।
রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি, ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা ইত্যাদি নানা খাতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকে, সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
মি. কায়কাউস বলছেন, ”কিন্তু সামনে আমাদের ঘাটতি যদি বাড়ে, সেজন্য আলোচনা সাপেক্ষে একটা সাপোর্ট চাওয়া হয়েছে। এরকম বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার করেছি। এটা কোন বেলআউট নয়। আগে প্রজেক্ট এইড হিসাবে দেয়া হতো, এখন আমরা বাজেটারি সাপোর্ট চেয়েছি”।
তিনি জানান, করোনাভাইরাসের সময় জাইকা, এডিবি, আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকেও বাজেটারি সাপোর্ট নেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে ৭৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নেয়া হয়েছিল আইএমএফ থেকে।
মি. কায়কাউস বলছেন, ”বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় সবসময়েই এখানে ঘাটতি থাকে। কিন্তু সেই ঘাটতি যদি অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ডলার ঋণ নিয়ে সেটা মেটানো হয়। এটা অতীতেও করা হয়েছে।”

ছবির উৎস,GETTY IMAGES
আইএমএফের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার সঙ্গেও বাজেট সহায়তা নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা করতে চায় বাংলাদেশ।
আইএমএফের ঋণ নিয়ে এতো আলোচনা কেন?
বাংলাদেশ ১৯৭২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের একটি সদস্য দেশ। এর আগে একাধিকবার এই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিলেও তা কখনো ১০০ কোটি ডলারের সীমা পার হয়নি।
এবারই এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে এত বড় অংকের ঋণ চাইছে বাংলাদেশ।
মি. শ্রীনিবাসন রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আভাস দিয়েছেন, বাংলাদেশকে হয়তো এই ঋণ পেতে হলে আইএমএফের এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির মতো নিয়মিত কর্মসূচীতে যেতে হবে।
সেক্ষেত্রে আইএমএফের দেয়া বেশ কিছু শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে। শর্তের ব্যাপারে আলোচনার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীও।
রয়টার্স জানিয়েছে, বাংলাদেশের এই অনুরোধের ব্যাপারে অক্টোবর থেকে আলোচনা শুরু হতে পারে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে ঋণ বা আর্থিক সহায়তা নেয়া বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। কিন্তু আইএমএফের এই তহবিল নিয়ে এতো আলোচনা কেন হচ্ছে?
আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতিগত বিষয়ে সংস্কারের কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। আর্থিক খাতের সংস্কারের এসব শর্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠার আশঙ্কায় অনেক সময় সরকার ঋণ নিতে চায় না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেরকম প্রয়োজনীয়তা গত এক দশকে দেখা যায়নি। ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার এই পথ বেছে নিয়েছে।
”পাশাপাশি গত এক দশকে একদিকে যেভাবে সরকার এ ধরনের বড় ঋণ নিতে তাগিদ অনুভব করেনি, আবার সংস্কারের সাথে সম্পর্কিত শর্তগুলো মেনে ঋণ নিতে সরকারের আগ্রহও বেশি ছিল না।”
অতীতে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আন্দোলন করতেও দেখা গেছে কোন কোন রাজনৈতিক দলকে।
সেলিম রায়হান বলছেন, ”আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের কথা যদি আমরা ধরি, এক দশক বা দুই দশক আগের তুলনায় তাদেরও একটা পরিবর্তন হয়েছে। তারা তখন দেশ ভেদে অবস্থার কথা ততোটা না ভেবে স্ট্যান্ডার্ড টেমপ্লেট টাইপের পরিবর্তনের পরামর্শ দিতো। ফলে আইএমএফর ব্যাপারে অনেকের এক ধরনের রিজার্ভ মনোভাব ছিল। এখন কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান যেসব সংস্কার পরামর্শ দেয়, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। তবে এসব সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের মধ্যে একটা দ্বিধা কাজ করে।”
ব্যাংকিং এবং কর খাতের সংস্কারের মতো শর্ত যদি এই ঋণের সাথে দেয়া হয়, সেটা দেশের আর্থিক খাতের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলেই মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বিবিসি