Type to search

Lead Story আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ রাজনীতি

টিউলিপের কানেকশনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিবিসির প্রতিবেদনে

সিটি মিনিস্টারের পদ ত্যাগ করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক। তবে তিনি বৃটেনে এমপি আছেন এখনো। তার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের সময় মানুষকে ‘গুম’ করা হয়েছে। এসব বিষয় জানার পরও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার সিটি মিনিস্টার বানিয়েছেন টিউলিপকে। তাহলে কেন তাকে একজন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছেন স্টারমার? এ প্রশ্ন উঠছে এখন। এ খবর দিয়ে বিবিসিতে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন লিখেছেন তাদের রাজনৈতিক ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদক জো পাইক। ‘হার আন্টস রেজিম ডিজঅ্যাপেয়ার্ড পিপল- সো হোয়াই ডিড স্টারমার মেক হার এ মিনিস্টার?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি আরও লিখেছেন, টিউলিপের ‘স্ক্যান্ডালে জড়িত খালা’র সঙ্গে টিউলিপের যোগসূত্রের বিষয় দীর্ঘদিন ধরে জানে লেবার পার্টি। ২০১৬ সালে মীর আহমেদ বিন কাসেমকে গুমের বিষয়টি প্রথম টিউলিপের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। টিউলিপ সিদ্দিক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানবাধিকারের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। কিন্তু মীর আহমেদ এবং বাংলাদেশের অন্য যারা ‘গুম’ হয়েছেন, তারা টিউলিপের সেই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে জঘন্য এক উত্তেজনার প্রতিনিধিত্ব করেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে- এসব বিষয় সামনে আসার পরও কেন লেবার পার্টি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলো?
জো পাইক তার প্রতিবেদনে লিখেছেন- বাংলাদেশে নিজের বাড়ি থেকে রাতের বেলা সশস্ত্র ব্যক্তিরা অপহরণ করে মীর আহমেদ বিন কাসেম (৪০)কে। এ সময় তার চার বছর বয়সী মেয়ে এত ছোট ছিল যে, সে বুঝতেই পারেনি আসলে কি ঘটেছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মীর আহমেদ বিন কাসেম বলেন, আমার পা ছিল খালি। তারা আমাকে সেভাবেই টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। এ সময় আমার জুতা হাতে নিয়ে পেছন  পেছন দৌড়ে আসে আমার ছোট্ট মেয়ে। সে বলতে থাকে- বাবা জুতা নাও। সে হয়তো ভেবেছিল- আমি বাইরে যাচ্ছি।

মীর আহমেদ বিন কাসেমকে আট বছর ধরে হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো অবস্থায়, চোখ বাঁধা অবস্থায় নিঃসঙ্গ কারাগারে রাখা হয়। তিনি এখনো জানেন না সেটা কোথায় এবং কেন তাকে ওভাবে আটকে রাখা হয়েছিল। তিনি বৃটেনে প্রশিক্ষিত একজন ব্যারিস্টার। বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের অন্যতম তিনি। তারাই হলেন- বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচক। শেখ হাসিনা দুই মেয়াদে কমপক্ষে ২০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। অবশেষে গত আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হন। শেখ হাসিনার আমলে যে পরিমাণ ভয়াবহ সহিংসতা হয়েছে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে তার চেয়ে ভয়াবহতা আর কখনো দেখা যায়নি। ওই সহিংসতায় কয়েকশত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ক্ষমতায় হাসিনা কোনোমতে ঝুলে থাকার জন্য তার শেষ ক্ষমতার দিনেও কমপক্ষে ৯০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তার (টিউলিপ) অবস্থানের দিক দিয়ে বিতর্কিত, শেখ হাসিনা বৃটেনে ক্ষমতাসীন লেবার দলের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের খালা। একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের দুর্নীতি বিরোধী মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন টিউলিপ। তিনি এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যানও করেছেন। অভিযোগের মধ্যে আছে- বাংলাদেশে অবকাঠামো বিষয়ক খরচের খাত থেকে টিউলিপের পরিবার কমপক্ষে ৩৯০ কোটি পাউন্ড আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া তার খালার (শেখ হাসিনা) লন্ডনে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া প্রোপার্টি ব্যবহার করেছেন টিউলিপ। পরে সরকারের এথিক বিষয়ক পর্যবেক্ষক খতিয়ে দেখেছে যে, টিউলিপ মন্ত্রিত্বের আচরণবিধি ভঙ্গ করেননি। তবে তিনি যেকোনোভাবে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি।

এ ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের ‘জাজমেন্ট’ নিয়ে হতাশাজনক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশি ঐতিহ্যের জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য লেবার দলের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। টিউলিপ সিদ্দিক দীর্ঘদিন ধরে তার নির্বাচনী আসনের নাজানিন জাঘারি-র‌্যাটক্লিফকে ইরান থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার খালার (শেখ হাসিনা) শাসনামলে দুর্ভোগ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি তুলনামূলক উদাসীনতা দেখান। ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। কয়েক বছর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নিজের খালা শেখ হাসিনার সঙ্গে এর আগে দেখা গেছে টিউলিপকে। বিবিসি টেলিভিশনে তাকে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র হিসেবে। ২০১৫ সালে লেবার দলের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন টিউলিপ। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তার ওয়েবসাইটের দুটি পেজ মুছে ফেলা হয়েছে। এ দুটি পেজে দলটির সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু একবার যখন পার্লামেন্টে প্রবেশ করলেন টিউলিপ, তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন- বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা বা ইচ্ছা তার নেই। সুতরাং এসব সম্পর্কের কথা কোনো গোপন বিষয় ছিল না। কিন্তু এ বিষয়গুলোকে হয়তো লেবার দলের  ভেতরে খারাপ হিসেবে দেখা হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ থেকে নিজেকে দূরে রাখার সামান্য লক্ষণ হিসেবেও দেখা হয়নি। তখনকার লেবার দলের এমপি জিম ফিটজপ্যাট্রিক ২০১২ সালে হাউস অব কমন্সে বলেন যে- তারা হলেন ‘অঙ্গ সংগঠন’। এই উষ্ণতা শেয়ার করেন তার অনেক সহকর্মী। ২০১৫ সালে পাশাপাশি আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের সময়েই পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন স্টারমার। তিনিও বহুবার শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারপর ২০২২ সালে বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা লন্ডনে গিয়েছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে। সেখানেও তাদের সাক্ষাৎ হয়। এই মিটিংয়ে ‘হৃদয়ভঙ্গকারী ও হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন মীর আহমেদ বিন কাসেম।

কিয়ের স্টারমারের একজন মিত্র যুক্তি দেন যে, তখন শেখ হাসিনার সঙ্গে স্টারমারের সাক্ষাৎ যথার্থই আইনগতভাবে হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে তার (হাসিনা) রাজনীতিকে উৎসাহিত করা হয়নি। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে পাশে রাখার চেষ্টা করেছে লেবার পার্টি। এতে বৃটেনের রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিফলিত হতে পারে, বিশেষ করে রাজধানী শহরের কিছু অংশে। লেবার দলের একজন ক্যাম্পেইনার বলেন, বাংলাদেশি ভোটের বিষয়টি অনুধাবন করতে না পারলে পূর্ব লন্ডনে আপনি সফল হতে পারবেন না। যাই হোক, যারা দেশের বিভক্তি ও অস্থির রাজনীতিকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়, শেষ পর্যন্ত তারা ওইসব মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলে- যারা মনোমুগ্ধকর কিছু করছে। ওই ক্যাম্পেইনার বলেন, আপনি কি বলবেন এবং কি করবেন- সে বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সতর্কতা গ্রহণ করা উচিত। আপনি যদি (বাংলাদেশের) একটি দলের পক্ষে খুব বেশি প্রকাশ্যে অবস্থান নেন, তাহলে আপনি সমালোচিত হবেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বৃটেনের কমপক্ষে ১৭টি আসনে বাংলাদেশি ভোটের যোগ্য মানুষের সংখ্যা লেবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়েও বেশি। কিয়ের স্টারমার নির্বাচিত হয়েছেন হলবর্ন অ্যান্ড সেইন্ট প্যানক্রাস আসনে। ওই আসনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কমপক্ষে ৬ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের বসবাস আছে।

এই উত্তাপ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা কিয়ের স্টারমারের জাজমেন্টের ওপর কি একটি মেঘ সৃষ্টি করেছে সবেমাত্র জুলাইয়ে নির্বাচনে জয়ের পরে, বিশেষ করে দুর্নীতির ক্ষেত্রে। বৃটেনে দুর্নীতিবিরোধী দায়িত্বে ট্রেজারি মন্ত্রী হিসেবে টিউলিপ সিদ্দিককে তার নিয়োগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লেবার দলের এক সূত্র বলেছেন, নিজের বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্রদের বিষয়ে কিয়ের স্টারমার চোখ বন্ধ করে রাখেন। এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। এক দশক ধরে বাংলাদেশি রাজনীতির সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিকের সংযোগের বিষয়ে আলো ফেলেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তিনি সবকিছুর বিষয়ে কথা বলেছেন।  ডেভিড বার্গম্যান বলেন, লেবার পার্টি যদি ক্ষমতায় না যেতো, টিউলিপ সিদ্দিক যদি মন্ত্রী না হতেন এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের যদি পতন না ঘটতো, তাহলে এ বিষয়টি বড় কোনো কাহিনী হতো না। তিনি যুক্তি দেন, দলের ভেতরের কাউকে না কাউকে এ বিষয়টি অনেক বছর আগে উদ্বেগের সঙ্গে তুলে ধরা উচিত ছিল। বার্গম্যান আরও বলেন, বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুমের বিষয়ে সাড়া দিতে টিউলিপ সিদ্দিক যখন ব্যর্থ হলেন, তখন  সেটাই ছিল প্রথম ‘ব্লাইন্ডস্পট’। তারপর আওয়ামী লীগের বৃটেন শাখার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক সে বিষয়টি হলো আরেকটি ‘ব্লাইন্ডস্পট’।

সাংবাদিক জো পাইক লিখেছেন- যখন আমি এ বিষয়টি লেবার দলের একজন এমপি’র কাছে তুলে ধরলাম, তখন তারা বলছিল- বৃটিশ মিডিয়া এমনকি লেবার পার্টির বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ব্লাইন্ডস্পট আছে। তারা বললেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রায় ৬ লাখ মানুষ আছেন। এটা এমন একটি দেশ, যা হলো বিশ্বের অষ্টম সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর বসবাস। কিন্তু ৫ই আগস্টের পর আমরা বৃটিশ মিডিয়ার পক্ষ থেকে কোনো উঁকিঝুঁকির খবরও শুনতে পাইনি। হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত কিছু সময়ের জন্য গর্জে উঠতে পারে, যা স্টারমারের দলকে সামনের মাসগুলোতে সমাধান করার জন্য আরও সমস্যা নিয়ে আসবে, যখন টিউলিপ সিদ্দিক লেবার দলের একজন এমপি থাকবেন। হাসিনার শাসনের পতনের পর মীর আহমেদ বিন কাসেমকে আকস্মিকভাবে তার সেলে জাগিয়ে তোলা হয়। একটি গাড়িতে ঢুকিয়ে একটি খাদের কিনারে নিয়ে ফেলে দেয়া হয়। এরপরই দুই মেয়ের সহযোগিতায় তাকে বাড়িতে ফিরতে দেয়া হয়। সন্তানদেরকে তিনি ২০১৬ সালে সর্বশেষ দেখেছিলেন। এখন তারা যুবতী। মীর আহমেদ বিন কাসেম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি বাস্তবেই তাদেরকে চিনতে পারিনি। তারাও আমাকে চিনতে পারেনি। এটা কঠিন বিষয় যে, আমি আমার কন্যাদেরকে বড় হওয়া কখনো দেখতে পারিনি। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কে হারিয়ে ফেলেছি। আমি তাদের শৈশবকে মিস করি।

বিবিসি

Translate »