‘চ্যালেঞ্জিং সময়ের একটি সাধারণ বাজেট, সৎ করদাতারা তিরস্কৃত’
গবেষণা সংস্থা সিপিডি আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘চ্যালেঞ্জিং সময়ে একটি সাধারণ বাজেট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সংস্থাটির মতে বাজেটে ‘সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা নেই, অথচ আছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কথা’ এবং একই সাথে কালো টাকা আবারো সাদা করার সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের তিরস্কৃত করা হয়েছে।
“চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে জনজীবনে স্বস্তি আনাসহ যে বিষয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল সেগুলোর বিষয়ে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি,” বলছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
তার মতে বাজেটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা আছে কিন্তু কীভাবে সেটি অর্জিত হবে তা বলা হয়নি। সব মিলিয়ে এ বাজেট দিয়ে চলমান সংকট মোকাবেলা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তারা।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটিই তার প্রথম বাজেট। এই বাজেটের বিষয়ে নিজেদের মতামত জানাতেই আজ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলো সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি।
কেন বাজেট সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়
ফাহমিদা খাতুন বলেছেন দেশে এখন যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে সে প্রেক্ষাপটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ও কর সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে জনজীবনে স্বস্তি আনার পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল।
“কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। মানুষ অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে গত দু বছর ধরে। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি নিয়ে এর সমাধান হবে না। বরং রাজস্ব সহযোগী পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো দূরুহ হবে,” বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, দেশে সরকারি হিসেবেই মূল্যস্ফীতি গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নয় শতাংশের বেশি। এমনকি সরকারি সংস্থা বিবিএস এর হিসেবে গত মাসেই মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকে সঞ্চয় ভাঙ্গছেন এমন খবর গত দু বছর ধরেই নানা সংবাদমাধ্যমে প্রায় নিয়মিত।
পাশাপাশি বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী গত মাসে অর্থাৎ মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। যদিও অন্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলোর হিসেবে এটি প্রকৃত অর্থে আরও বেশি।
সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলো মূল্যস্ফীতি কমানো দূরে থাক, বরং উস্কেও দিতে পারে।
“পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও বড় চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ বাজেটে বিভিন্ন সেবার ওপর কর বসেছে যেগুলো পেতে মানুষকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে বছরে চার বার মূল্যবৃদ্ধি হবে এবং সে কারণে সেবার ব্যয় বাড়বে। আবার যেসব খাতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে তার সুবিধা আমদানিকারকদের পকেটে যাবে। এগুলোর সুফল সাধারণ মানুষ পায় না,” বলছিলেন মি. মোয়াজ্জেম।
যদিও বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই এবারের বাজেটের অন্যতম অগ্রাধিকার।
“আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান দুই নীতি- মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির আওতায় ঘাটতি কমিয়ে ও কৃচ্ছতাসাধনের মাধ্যমে এটি সম্ভব হবে,” বলেছেন তিনি।
‘রিজার্ভে লক্ষ্যমাত্রা আছে কিন্তু অর্জনের উপায় নাই’
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় তখনকার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন অল্প সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তিন বছর আগের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমতে কমতে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ১৯ বিলিয়ন ডলারের মতো।
রিজার্ভ নিয়ে ধারাবাহিক সংকট মোকাবেলায় গত মাসেই ডলারের দাম একদিনে রেকর্ড সাত টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মাসে গত প্রায় চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ২২৫ কোটি ডলার এসেছে রেমিট্যান্স হিসেবে।
এবারের বাজেটে ২০২৫ সালের জন্য মোট রিজার্ভ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলার এবং বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে আগামী অর্থবছরে ডলারের বিনিময় হার হবে ১১৪ টাকা, যা এখন ১১৭ টাকার কিছুটা বেশি।
সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে ফাহমিদা খাতুন বলছেন রিজার্ভের ক্ষেত্রে বাজেটে কিছু লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হলেও সেগুলো কীভাবে অর্জিত হবে তা বলা হয়নি।
“দু’বছর ধরে অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে রয়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নড়বড়ে এবং অর্থনীতির সব সূচকেই ক্ষত দেখা দিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের আশা ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রিজার্ভ তলানিতে যাওয়া বন্ধ করে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার স্পষ্ট পদক্ষেপ থাকবে,” বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, রিজার্ভের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বছর জুড়ে ব্যাপক রিজার্ভ আনতে হবে। অথচ টাকার মান বাড়ানোর কথা শোনা যাচ্ছে।
এবারের বাজেটে কিছু পণ্যের শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হলেও বরাবরের মতোই এর সুবিধা ভোক্তাদের কাছে কতটা পৌঁছাবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
“যেসব পণ্যের শুল্ক রেয়াত দেয়া হলো তার সুবিধা ভোক্তা কতটা পাবে সেটাই প্রশ্ন। কারণ বাজারে সেভাবে দাম কমে না। আর যেখানে কর বাড়ানো হলো সেটা কিন্তু ঠিকই ভোক্তাদেরই দিতে হয়। অর্থাৎ দিন শেষে ভোক্তাদের ওপরই বেশি চাপ পড়ে যায়,” বলছিলেন ফাহমিদা খাতুন।
তবে তিনি বাজেটে দেশীয় শিল্পকে সহযোগিতা করার উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছেন তারা এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
‘সৎ করদাতারা তিরস্কৃত’
বাংলাদেশের এবারের বাজেটেও কালো টাকা কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করছে বিভিন্ন মহল।
আর এ সমালোচনার নতুন আরেকটি কারণ হলো- এবারই প্রথম বাজেটে বলা হয়েছে যারা কর দিয়ে টাকা বৈধ করবেন তাদের অর্থের উৎস নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।
ফাহমিদা খাতুন বলেছেন যারা নিয়মিত কর দেয় তাদের সর্বোচ্চ ত্রিশ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হবে, অথচ যারা কর দেননি কিংবা অসৎভাবে আয় করেছেন তাদের জন্য ১৫ শতাংশ।
“এটা কোন ধরনের সামাজিক ন্যায্যতা? এটা সৎ করদাতাদের জন্য অন্যায়। নৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য না। এটা প্রতিবছর থাকে কিন্তু কালো টাকা খুব বেশি সাদা হয় না। যদি হতো কর জিডিপি হার এত কম থাকার কথা না। মূলত এর মাধ্যমে যারা কর ফাঁকি দিচ্ছে তাদের উৎসাহিত করছে আর কর যারা দেয় তাদের তিরস্কৃত করা হচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন ঋণ খেলাপি, করখেলাপি এবং টাকার পাচারের একটি দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে।
“বাজেটে দেখলাম পনের শতাংশ বিনিয়োগ করলে তাকে আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না- সেই লাইন যোগ করা হয়েছে। যা আগে ছিল না। এটা অগ্রহণযোগ্য এবং অর্থনৈতিকভাবেও ফলপ্রসূ না,” বলেন ড. রহমান।
ফাহমিদা খাতুন বলছেন, “এমপিদের কাছে গাড়ির শুল্ক দেয়ার আবেদন করা হয়েছে। এর জন্য আইন পরিবর্তন করতে হবে এমপিদেরকেই। দেখা যাক সেই পরিবর্তন এনে তারা কিছুটা হলেও কর দেয়ার উদারতা দেখান কি না।”
‘নতুন সরকারের পুরনো বাজেট’
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন বাজেটটিকে একটি নতুন সরকাররে নতুন বাজেট বলে মনে হয়নি। এবং একজন নতুন অর্থমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে যে ধরনের মুনশিয়ানা আশা করা হয়েছিলো সেটি তারা দেখাতে পারেননি।
“এ সময়কালে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য যতটা আর্থিক সংকোচন দরকার- সেটা সাধারণ মানুষের ওপর যেভাবে চাপানো হচ্ছে তা কিন্তু সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। আবার সরকারের হাতে কালো টাকা ধরার কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেই,” বলছিলেন তিনি।
সিপিডি তার বাজেট প্রতিক্রিয়ায় আরও বলছে দেশের সামষ্টিিক অর্থনীতির যন্ত্রণাগুলোর মধ্যে আছে রাজস্ব আহরণ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক খাতের দুরবস্থা, তারল্য সংকট, রপ্তানি খাতে নিম্নমুখিতা, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ, আমদানি কমে যাওয়াসহ নানা কিছু।
“অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও নিন্মগতি। বিদ্যুৎ জ্বালানিতে সরবরাহ সমস্যা আর উচ্চ দাম। এর মধ্যেও বাজেটে যেই প্রক্ষেপণ করা হয়েছে তার সাথে বাস্তবতার মিল নেই। যেমন চলতি অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেটেই প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সেখানে আগামী অর্থবছরের জন্য ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী।”
ফাহমিদা খাতুন অবশ্য বলেছেন পরিস্থিতি বিবেচনায় সংযত বাজেট প্রস্তাবনার যে সুপারিশ তারা করেছিলেন তার কিছুটা চেষ্টা বাজেটে তারা লক্ষ্য করেছেন।-বিবিসি
এবিসিবি/এমআই