রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় এড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরও সহায়তার আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আরও সহায়তা দেওয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে আমরা এই মানবিক বিপর্যয় এড়াতে পারি।’
শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যৌথ এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দায়িত্ব গ্রহণ এবং শরণার্থীদের পাশাপাশি তাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময় বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত একটি ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে আপনাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা।’
বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে গুতেরেস আশ্বস্ত করেছেন যে, জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, আস্থা ও পুনর্মিলন জোরদারে সহায়তা করতে প্রস্তুত।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আপনারা জাতিসংঘকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে গণ্য করতে পারেন, যারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করবে।’
তিনি রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের অসাধারণ উদারতার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘এটি আপনাদের টেকসই মানবিক মনোভাবের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।’ তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয় সম্প্রদায়, সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা এক মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
গুতেরেস আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় প্রদান করে বাংলাদেশ সংহতি ও মানবিক মর্যাদার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যদিও এটি সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মূল্য চুকিয়েছে। বিশ্ব এই উদারতাকে কখনও স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে পারে না।’
জাতিসংঘ মহাসচিব উল্লেখ করেন, তিনি গতকাল কক্সবাজারে বলেছিলেন যে বিশ্ব এখন এক গভীর মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঘোষিত আর্থিক সহায়তা হ্রাসের কারণে, ২০২৫ সালে মানবিক সহায়তার জন্য ২০২৪ সালের তুলনায় কেবলমাত্র ৪০ শতাংশ সাহায্য পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এর ফলে ভয়াবহ পরিণতি ঘটবে, যার মধ্যে খাদ্য রেশনিংয়ের নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়াও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’
‘এটি সম্পূর্ণ বিপর্যয় ঘটবে’ উল্লেখ করে গুতেরেস বলেন, মানুষ দুর্ভোগ পোহাবে এবং প্রাণ হারাবে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশ ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধভাবে কাজ করছে, যাতে রোহিঙ্গা সংকটের একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বের করা যায়, যা তাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব জানান, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন,‘আমরা জানি, সেখানে পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা বেড়েই চলেছে, যার ফলে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে এবং মানুষ দেশান্তরী হতে বাধ্য হচ্ছে।’
তিনি মিয়ানমারের সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানান এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতা আর না বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন— যাতে গণতন্ত্রের শেকড় গাঁথতে পারে।
গুতেরেস বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের সব মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাসের শুভেচ্ছা জানান।
তিনি বলেন, রমজান হলো আত্ম-অনুসন্ধান, আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণ ও ঐক্যের সময়।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, প্রতি বছর তিনি সংহতির বার্তা নিয়ে বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সময় কাটান, যারা কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাস করছে, তাদের সঙ্গে রোজা রাখেন এবং তাদের দুর্দশার ওপর বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জাতিসংঘ প্রধান বলেন, ‘এই বছর, আমি বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাতে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাদের আশ্রয়দানকারী বাংলাদেশি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে পারি।’
-বাসস