স্মৃতিশক্তি নিয়ে বিপাকে বাইডেন, রেগে বললেন ‘আমার স্মৃতি ঠিক আছে’

অতি গোপনীয় নথি রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তদন্তের মুখে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেখানে তার স্মৃতিশক্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে নিজেকে স্বাভাবিক দাবি করে তদন্তের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মি. বাইডেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আকস্মিক এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি বলেন, “আমার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে।”
মি. বাইডেনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ তোলা হয়েছিল যেখানে বলা হয়েছে যে, তিনি তার ছেলে কবে মারা গেছে তা মনে করতে পারছিলেন না। এর উত্তরে মি. বাইডেন বলেন, “তিনি কীভাবে এই প্রশ্ন তোলার সাহস পান?”
স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট হার অতি গোপনীয় নথি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে মি. বাইডেনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ গঠন করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু তার তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু কঠোর সমালোচনা রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে প্রেসিডেন্টের স্মৃতিশক্তিতে “উল্লেখজনক সীমাবদ্ধতা” রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নথিগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করার অভিযোগ আনাটা মুশকিল কারণ, “বিচারের সময় মি. বাইডেন বিচারকের সামনে নিজেকে একজন সহানুভূতিশীল, সদালাপী এবং দুর্বল স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন বয়স্ক মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করবেন, আমাদের সামনেও তিনি যেটি করেছেন।”
এর প্রতিক্রিয়ায় মি. বাইডেন বলেছেন, বয়স সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তিনিই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।
গত বছর স্পেশাল কাউন্সেলের কাছে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে তিনি বলেন, “সেদিন আমি অনেক ব্যস্ত ছিলাম। আমি তখন একটি আন্তর্জাতিক সংকট নিয়ে কাজ করছিলাম।”
সাক্ষাৎকারের একদিন আগে, সাতই অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি।
এ বছরের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মি. বাইডেনের বয়স ভোটারদের কাছে একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজায় সাম্প্রতিক ঘটনার বিষয়ে মন্তব্য করতে বললে তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার সংবাদ সম্মেলনে মেক্সিকো এবং মিশরের প্রেসিডেন্টের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন।
“আমি মনে করি আপনারা এরইমধ্যে জানেন যে, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট, সিসি, মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য দ্বার খুলতে চান না। আমি তার সাথে কথা বলেছি। আমি তাকে মানিয়েছি”, বলেন তিনি।
মি. বাইডেনের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে-
১. স্মৃতিশক্তি নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্টের স্মৃতিশক্তির “উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা আছে বলে মনে হচ্ছে।”
প্রতিবেদনে মি. বাইডেনের বেশ কিছু উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে তার স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আনে।
প্রতিবেদনের একটি প্যারায় স্পেশাল কাউন্সেল মি. বাইডেনের বইয়ের ছায়ালেখক মার্ক জোনিৎজারের সাথে দীর্ঘসময় ধরে চলা একটি সাক্ষাৎকার তুলে ধরেন। যেখানে মনে হচ্ছিলো যে, বারাক ওবামার সাথে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে করতে বেগ পেতে হচ্ছিলো তাকে।
“২০১৭ সালে মি. জোনিৎজারের সাথে মি. বাইডেনের রেকর্ড করা কথোপকথনগুলো খুব বেশি ধীরগতির ছিল। এগুলোতে মি. বাইডেন ঘটনা মনে করতে চেষ্টা করছেন, মাঝে মাঝে জোর করে মনে করার চেষ্টা করছেন এবং কখনো কখনো নিজের নোটবই খুলে ওই ঘটনার সম্পর্কিত তথ্য খোঁজার চেষ্টা করছেন।”
প্রতিবেদনে- এর ছয় বছর পর স্পেশাল কাউন্সেলের দপ্তরে মি. বাইডেনের সাক্ষাৎকারের বিষয়ে বর্ণনা করা হয়, যেখানে তিনি স্বেচ্ছায় গিয়েছিলেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, মাঝের এই সময়টাতে তার স্মৃতিশক্তি আরো বেশি খারাপ হয়েছে।
“আমাদের দপ্তরের সাথে সাক্ষাৎকারে, মি. বাইডেনের স্মৃতিশক্তি সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিল। তিনি মনে করতে পারছিলেন না যে তিনি কখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সাক্ষাৎকারের প্রথম দিন তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে তার দায়িত্বের শেষ দিন কবে ছিল। (২০১৩ সালে- তখন কি আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম না?) এছাড়া দ্বিতীয় দিনে তিনি মনে করতে পারছিলেন না যে তিনি কবে থেকে তার দায়িত্ব যোগ দিয়েছিলেন (২০০৯ সালে, আমি কি তখনো ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম?)”
অন্য আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, মি. বাইডেন এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে করতে পারছিলেন না যেগুলোর কারণে শুরুর দিকে ওবামা প্রশাসনে বিভক্তি দেখা দিয়েছিল।
বিশেষ করে বলতে গেলে, তিনি ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে সেনা বৃদ্ধি নিয়ে যে বিতর্ক এবং জটিলতা দেখা দিয়েছিল তা মনে করতে পারছিলেন না। তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট তখন হামিদ কারজাইয়ের সরকারকে সহায়তা করতে আফগানিস্তানে অতিরিক্ত ৩০ হাজার মার্কিন সেনা পাঠাতে প্রেসিডেন্ট ওবামার সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন না। এর পরিবর্তে তিনি বিশেষ অভিযানের মিশন এবং ড্রোন হামলা চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন।
“আফগানিস্তান বিতর্কের বিষয়ে বর্ণনা করতে গিয়ে তার স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে আসছিল। অথচ এই বিষয়টি তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যান্য তথ্যের সাথে তিনি ভুল করে বলে ফেলেন যে, জেনারেল কার্ল আইকেনবেরির সাথে তার ‘বাস্তবিক মতপার্থক্য ছিল’। কিন্তু আসলে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে দেয়া থ্যাংকসগিভিং চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে, আইকেনবেরি একজন মিত্র।”
মি. হার এর প্রতিবেদনের অন্য জায়গাতে লেখা হয়েছে যে, মি. বাইডেন মনে করতে পারছিলেন না যে তার ছেলে বিউ কবে মারা গেছে।
“তার ছেলের মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর পর তিনি তার মনে করতে পারছিলেন না যে সে কবে মারা গেছে।”

ছবির উৎস,FBI
২. কুকুরের বিছানার পাশেই অতি গোপনীয় নথি সংরক্ষণ
প্রতিবেদনে অন্য অংশ মি. হার বর্ণনা করেছেন যে, ডিলাওয়ারে তদন্তকারীরা মি. বাইডেনের বাড়িতে আফগানিস্তান বিষয়ক অতি গোপনীয় বহু নথি কীভাবে পুরনো জিনিসপত্র রাখার জন্য ব্যবহৃত পুরনো গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নথিগুলো “প্রায় ধসে পড়া একটি কুকুর বহন করার বাক্স, একটি কুকুরের বিছানা, একটি খালি বালতি, একটি ভাঙ্গা ল্যাম্প যেটি ডাক্টটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে, গাছ লাগানোর মাটি এবং আগুন জ্বালানোর সিনথেটিক কাঠের” পাশ থেকে খুঁজে পাওয়া গেছে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “যুক্তিসঙ্গত একজন বিচারক কখনোই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন না যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তি এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অতি গোপনীয় নথি যা তার উত্তরাধিকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো এভাবে সংরক্ষণ করতে পারেন।”
এর পরিবর্তে মি. হার আবারো মি. বাইডেনের স্মৃতিশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এই নথিগুলো এভাবে খুঁজে পাওয়া দেখে মনে হচ্ছে যে, “কোনো ব্যক্তি হয়তো ভুলে গিয়ে কিংবা না জেনে অতি গোপনীয় নথি এমন একটি জায়গায় সংরক্ষণ করেছে।”
৩. বাইডেন মনে করতেন আফগানিস্তানে ওবামা বড় ভুল করতে যাচ্ছেন
ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই মি. ওবামাকে বোঝানো হয়েছিল যে, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর সংখ্যা বাড়ানোটাই দেশটিতে স্থিতিশীলতা রক্ষার একমাত্র পন্থা।
এর আগে বলা হয়েছিল যে মি. বাইডেন এই নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।
তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিজেকে “একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব” মনে করেন যিনি বিভিন্ন ঘটনার বিষয়ে লিখে রাখতে প্রায়ই ডায়েরি ব্যবহার করতেন। যার উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে তার কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বই লেখা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তান বিষয়ক গোপনীয় নথি নিজের কাছে রেখে দেয়ার পেছনে শক্ত উদ্দেশ্য ছিল মি. বাইডেনের। কারণ তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর বিষয়ে তিনি মি. ওবামার বিরোধিতা করেছিলেন।
“ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামার সেনা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ভিয়েতনামের মতোই একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল”, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, “তিনি এসব নথি রেখে দেখাতে চেয়েছিলেন যে, আফগানিস্তান সম্পর্কে তিনি সঠিক ছিলেন এবং তার সমালোচকরা ভুল ছিল।”
৪. ট্রাম্পের সাথে বৈপরীত্য
মি. হার অবশ্য মি. বাইডেনকে কৃতিত্ব দিয়েছেন কারণ তিনি গোপনীয় নথিগুলো খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথে সেগুলো তদন্তকারীদের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
“মি. বাইডেন ন্যাশনাল আর্কাইভ এবং বিচার বিভাগের কাছে গোপনীয় নথিগুলো ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার বাড়িসহ একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালানোর বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন এবং স্বেচ্ছায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য উপায়েও তিনি তদন্তে সহযোগিতা করেছেন।”
এর মাধ্যমে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট মি. ট্রাম্পের সাথে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করেছেন। কারণ মি. ট্রাম্প এর বিপরীত আচরণ করেছিলেন। মি. ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তার ফ্লোরিডার বাড়িতে বিভিন্ন ফাইল রাখার বিষয়ে তদন্ত প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
৫. গোপন ডায়েরি রাখার কারণ ছিল বাইডেনের
দীর্ঘদিন ধরেই মি. বাইডেন নোটবই রাখছেন যেখানে তিনি গোপনীয় মিটিংয়ের নানা ধরনের তথ্য লিখে রাখতেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আট বছর ধরে মি. বাইডেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তিনি নিয়মিত তার নোটবুকে গোপনীয় বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য লিখে রাখতেন যার মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্টের দৈনিক সংবাদ সম্মেলন এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক।
পরে এই নোটবইগুলো হোয়াইট হাউজ থেকে সরিয়ে ফেলা হয় এবং এগুলো বিভিন্ন তালাহীন ড্রয়ার এবং তার ডিলাওয়ার ও ভার্জিনিয়ার বাড়ির বেজমেন্ট থেকে উদ্ধার করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মি. বাইডেন জানতেন যে, তার নোটবইয়ে গোপনীয় তথ্য রয়েছে এবং এরপরও তিনি তার ছায়ালেখককে সেগুলো পড়ে শোনাতেন।
তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের উদাহরণ উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয় যে, তিনিও গোপনীয় তথ্য তার নোটবইয়ে লিখে রাখতেন। যার কারণে মি. বাইডেনের কাছে হয়তো মনে হতে পারে যে, তিনি এসব তথ্য নিজের কাছে রাখতে পারেন।
বিবিসি