সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘটে অচল মিয়ানমার
মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চলমান ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের ওপর জলকামান নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। সোমবার দেশটির রাজধানী নেপিডোতে এ ঘটনা ঘটে। নির্বাচিত নেতা অং সান সু চির মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আহ্বানে দেশটির হাজার হাজার মানুষ তৃতীয় দিনের মতো রাস্তায় নেমে ধর্মঘটে অংশ নেয়। দেশটির এক দশকের মধ্যে সর্ববৃহৎ প্রতিবাদের এক দিন পর এই ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়।
সোমবার সকালে ধর্মঘটের জন্য নেপিডোর রাস্তায় ১০ হাজার মানুষ জড়ো হয়। এ ছাড়াও দেশটির ম্যান্ডলে ও ইয়াঙ্গুনের মতো অন্যান্য শহরগুলোতেও উল্লেখযোগ্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এই বিক্ষোভের মধ্যে শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যাংক কর্মকর্তা এবং সরকারি কর্মচারীরাও রয়েছেন। প্রায় এক হাজার শিক্ষক ইয়াঙ্গুন থেকে সুলে প্যাগোডার দিকে যাত্রা করেন। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি লিখেছে, গত সপ্তাহে অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বড় বিরোধিতার মুখে পড়েছে মিয়ানমারের জেনারেলরা। সোমবার দেশজুড়ে বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারী সমবেত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি দাবি করেছেন। দেশজুড়ে বিক্ষোভ নিরসন করতে জান্তা সরকার এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ থেকে বিরত রয়েছে। তবে দাঙ্গা পুলিশের ওপর চাপ বাড়তে থাকায় সোমবার রাজধানী নেপিদোর রাজপথে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে ছত্রভঙ্গ করতে ব্যবহার হয়েছে জলকামান। হনিন থাজিন নামের ২৮ বছর বয়সি এক পোশাক শ্রমিক জানায়, ‘আজ কর্মদিবস, কিন্তু যদি আমাদের বেতন কেটে রাখাও হয়, তবু আমরা কাজে যাচ্ছি না।’
সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধিতায় গত সপ্তাহ থেকেই মিয়ানমারে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সোমবার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বিক্ষোভকারীদের ভিড় আরও বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক। সোমবার সকালে রাজধানী নেপিদোতে সমবেত হয় লাখ লাখ বিক্ষোভকারী। অন্যান্য শহরগুলোতেও বিপুল সংখ্যক মানুষ সমবেত হয়ে সেনাশাসনবিরোধী স্লোগান নিয়ে। গত সপ্তাহের অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন সেনা শাসকেরা। ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ থেকে বিরত রয়েছে সেনা সরকার। তবে বিক্ষোভ থামাতে বলপ্রয়োগ করতে দাঙ্গা পুলিশের ওপর ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। তার জেরেই সোমবার বিক্ষোভকারীদের ওপর জলকামান প্রয়োগ হয়েছে।
রাস্তায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা : সোমবার দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনে প্রতিবাদ মিছিলে শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গেরুয়া পোশাক পরা বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও যোগ দিয়েছেন এবং তারা সামনের সারিতে রয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) লাল ব্যানারের পাশাপাশি মিছিলে তারা বহুরঙা বৌদ্ধ পতাকাও উড়িয়েছেন। মিছিলের একজনের হাতে উঁচু করে ধরা এক কাগজে লেখা ছিল, ‘আমাদের নেতাদের মুক্তি দাও, আমাদের ভোটকে শ্রদ্ধা কর, সামরিক অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান কর।’ অন্য সাইনগুলোতে লেখা ছিল ‘গণতন্ত্র রক্ষা কর’, ‘স্বৈরতন্ত্রকে না বল’। অনেক প্রতিবাদকারী কালো পোশাক পরা ছিলেন। ২০০৭ সালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে ‘গেরুয়া বিপ্লবের’ পর এটিই ছিল সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। গেরুয়া বিপ্লব মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কারের গতি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল কিন্তু গত সোমবারের সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে ওই ধারা থমকে গেছে।
পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন : সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারজুড়ে বিক্ষোভের মধ্যেই ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) নির্বাচিত আইনপ্রণেতারা একটি কমিটি গঠন করেছেন। সোমবার তাদের গঠিত সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে অপরাধী কর্মকাণ্ড এবং সামরিক মন্ত্রিসভাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। দেশটির সংবাদমাধ্যম ইরাবতী এ খবর জানিয়েছে। নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হওয়া এনএলডির আইনপ্রণেতারা রোববার কমিটি রিপ্রেজেন্টিং পাইডাউংসু হ্লতাউ গঠন করেন। এই কমিটি হলো মিয়ানমারের ইউনিয়ন পার্লামেন্ট। গত সোমবার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এটিকে ভেঙে দেয় সেনাবাহিনী।
কমিটি গঠনের পর জাতিসংঘ দূত ও আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টকে এই বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। আহ্বান জানানো হয়েছে, সরকারি কাজের জন্য সামরিক শাসক নয়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ইউনিয়ন পার্লামেন্টের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হবে বলেও জানিয়েছে কমিটি। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশটির জনগণের বিক্ষোভের প্রশংসা করে তা অব্যাহত ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে কোনো প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে এক বছরের জন্য দেশটি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে, সু চিসহ তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি পার্টির (এনএলডি) জ্যেষ্ঠ নেতা এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।