সর্বভুক সরকার দেশ শেষ করার পাঁয়তারা করছে: মির্জা ফখরুল
বিএনপির রংপুর বিভাগীয় গণসমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকার সর্বভুকে পরিণত হয়েছে। সব খেয়ে ফেলছে। তারা ১৫ বছর ধরে দমন-অত্যাচার চালিয়ে সর্বনাশ করেছে। সারা দেশটাকে পুড়ে অঙ্গার করেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে শেষ করেছে অর্থনীতি। এখন আবার দেশটাকে শেষ করার পাঁয়তারা করেছে। তবে বিএনপি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে দেবে না। তিনি বলেছেন, তাঁদের একটাই দাবি- শেখ হাসিনা ও এ সরকারের পদত্যাগ। এ দাবিতেই এই গণসমাবেশ।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া শেখ হাসিনার অধীনে দেশে আর নির্বাচন হবে না। এই সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিলে নির্বাচনে জিতে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। দেশের অর্থনীতি মেরামত করার জন্য সেই সরকার কাজ করবে।
নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগেই গতকাল শনিবার (২৯ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় নগরীর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে গণসমাবেশ শুরু হয়। মঞ্চে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়। শুক্রবার রাত থেকেই সমাবেশে জড়ো হন হাজার হাজার নেতাকর্মী। রাতভর সেখানেই ছিলেন তাঁরা। ভোর থেকে বাড়তে থাকে জনস্রোত। যে যেভাবে পেরেছেন যোগ দিয়েছেন সমাবেশে। নানাভাবে সমাবেশে বাধা দেওয়া হলেও চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার পর এবার রংপুরে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করতে সক্ষম হয় দলটি।
প্রায় ৯ বছর পর রংপুরে বিএনপি বড় সমাবেশ করল। গতকাল মিছিলে-স্লোগানে মুখর ছিল পুরো শহর। সমাবেশে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড, ব্যানার এবং ধানের শীষসহ বড় বড় মিছিল নিয়ে আসতে থাকেন নেতাকর্মীরা। সকাল থেকেই নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো বিএনপির নেতাকর্মীদের দখলে চলে যায়। শহরের দলীয় কার্যালয়ে বসে আওয়ামী লীগের নেতারা সমাবেশ পর্যবেক্ষণ করেছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, শেখ হাসিনা বলছেন দেশে দুর্ভিক্ষ হবে। এটা হলে তাঁর সব দায় শেখ হাসিনা ও তার সরকারের। চিলমারীর বাসন্তীর উদাহরণ দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, চুয়াত্তরেও দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আপনারা বলেন, মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া হয়ে গেছে। আর এখন মানুষ খাবার পায় না। ১০ টাকা কেজির চাল কিনতে হয় ৯০ টাকায়। ডিমের ডজন ১৩৫-১৪০ টাকা। চিনির দাম ১৩০ টাকা। কী খেয়ে থাকবে মানুষ? শেখ হাসিনা বলেন, ধৈর্য ধরেন। আমরা কেমন করে ধৈর্য ধরব?
মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা বলছেন দিনের বেলা বিদ্যুৎ দেবেন না। অথচ ধরে ধরে চিতল মাছ খাচ্ছেন। ঘন ঘন বিদেশ যাচ্ছেন। আরাম-আয়েশ করছেন। এই হচ্ছে আওয়ামী লীগের চরিত্র। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নতুন বুলি দিচ্ছে জঙ্গিবাদ। তাদের নাকি দমন করা হবে। কিন্তু আপনাদের এই জঙ্গিবাদ অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেছে। এই বয়ানে আর কাজ হবে না।
তিনি বলেন, এই সরকার মিথ্যা বলে। মানবাধিকার নিয়ে যে রিপোর্ট দেয় তা মিথ্যা। নির্বাচনে জোর করে ভোট নিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এখন মানুষ এসব রুখে দেবে। বন্দুক, পিস্তল, লাঠি, রিভলবার সব ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হবে। শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে মানুষ জেগে উঠেছে। বাংলার মানুষ আর একবার বাংলাদেশকে স্বাধীন করবে। সেখানে কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে। তিনি বলেন, আলেম-ওলামারা যারা ধর্মের মধ্য দিয়ে সঠিক পথ দেখান তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছেন।
গণসমাবেশের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনারা অসাধ্যকে সাধন করেছেন। ৩৬ ঘণ্টা ধরে জলে-স্থলে সব পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বল প্রয়োগ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায়নি।’
রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামুর সভাপতিত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, সংসদ সদস্য ও দলের যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ, বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জামিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রিয়াজুল ইসলাম রিজু, সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল খালেক, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এসএম জিলানী, কৃষক দলের মহাসচিব শহিদুল ইসলাম (বাবুল), রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু, বিএনপি নেতা হেলেন জেরিন খান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ জুয়েল প্রমুখ বক্তব্য দেন।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেশের মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপির ভিত্তি হচ্ছে জনগণ। রংপুর বিভাগের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এই বিপ্লব কেউ থামাতে পারবে না। আমরা চাই বিপ্লবের মধ্যে শেখ হাসিনার পতন ঘটানো। তিনি বলেন, আগামীতে শেখ হাসিনা দুর্ভিক্ষ দেখতে পাচ্ছেন। একটা কথা পরিস্কার বলি, দুর্ভিক্ষ আসার আগেই বিদায় করে দেব। আগেও আওয়ামী লীগের সময় দুর্ভিক্ষ হয়েছে। এবার আপনাকে সেটা করতে দেওয়া হবে না।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, চিড়া-মুড়ি নিয়ে গামছা বেঁধে আজকের সমাবেশের জন্য কর্মীদের অপেক্ষা শেখ হাসিনার জন্য বড় বার্তা। আওয়ামী লীগ মাথার ওপরে জোর করে বসে আছে। আওয়ামী লীগের ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষকে ঠকানোর ইতিহাস। এ দল ক্ষমতায় গেলে দুর্ভিক্ষ আসে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ডাকাত সরদার। তাদের সরে যেতে হবে। মানুষ গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইয়ে নেমেছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নেমেছে। কেউ আটকাতে পারবে না।
ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার বাধা দিয়েছে গণসমাবেশ। কোনো লাভ হয়নি। যত বাধা তত বেশি জনসমাগম। সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ধর্মঘট দিয়ে মানুষের আসা বন্ধ করতে পারেননি। সমাগম দেখে মনে কম্পন তৈরি হয়েছে। ডিসেম্বরের ১০ তারিখের ১০ দিন আগে ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেব। আমরা দেখতে চাই, কীভাবে রোধ করেন।
রংপুরে বড় জমায়েত: রংপুরে বিএনপির গণসমাবেশস্থল আগের রাত থেকেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ছোট ছোট মিছিল নিয়ে বিভাগের আট জেলা থেকে এসেছেন নেতাকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, দীর্ঘ ৯ বছর পর বিএনপি এত বড় জমায়েত করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে রংপুরে বড় সমাবেশ করে বিএনপি। সেই সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন।
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা আগের রাতে সমাবেশস্থলে পলিথিন বিছিয়ে রাত কাটান। শনিবার সকাল থেকে সমাবেশস্থলে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। বিএনপি নেতাকর্মীরা গানবাজনা আর স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে রেখেছিল সমাবেশস্থল।
গতকাল সকাল থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কানায় কানায় পূর্ণ হয় সমাবেশস্থল। রংপুর মহানগরীর প্রবেশমুখ মাহিগঞ্জ সাতমাথা, মেডিকেল মোড়, টার্মিনাল রোডসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মিছিল নিয়ে আসতে দেখা যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান সড়কগুলোতে খণ্ড খণ্ড মিছিলের চাপ বাড়ে, বাড়ে স্লোগানের প্রতিধ্বনিও। বিএনপির দলীয় স্লোগান ছাড়াও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন নেতাকর্মীরা।
‘আত্মরক্ষায় লাঠি’: কর্মসূচিতে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী অংশ নিয়েছেন লাঠি হাতে। লাঠির সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা বাঁধা রয়েছে। আত্মরক্ষার্থে এই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তাঁরা।
লাঠি থাকা বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে বলেন, ‘আত্মরক্ষার জন্য নিয়েছি। আমরা তো রাস্তা অবরোধ করছি না। ভাঙচুর করছি না। তবে আগের সমাবেশগুলোতে আপনারা দেখেছেন আওয়ামী লীগ কীভাবে হামলে পড়েছে। পুলিশও তখন তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
এ ব্যাপারে মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা লাঠি হাতে কাউকে ঢুকতে দেইনি। লাঠি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে লাঠি হাতে সমাবেশস্থলে ঢুকতে পারে। শনিবার সমাবেশস্থলের আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্যকে অবস্থান নিতেও দেখা গেছে।
বাড়ি বাড়ি তল্লাশির অভিযোগ: বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সমাবেশকে ঘিরে শুক্রবার রাতভর বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ছাড়াও নেতাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও হানা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে তাঁবু টানিয়ে থাকা নেতাদেরও খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে।
হোটেলে মেলেনি খাবার: সমাবেশে যোগ দিতে আসা লোকজন খাবারের জন্য ভিড় করেছেন হোটেল-রেস্তোরাঁয়। তবে চাহিদা বেশি থাকায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও খাবার মেলেনি। সকাল থেকে নগরীর মেডিকেল মোড়, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি, সিটি বাজার, ধাপ সিটি বাজার, রাধাবল্লভ, কাচারিসহ বেশ কয়েকটি এলাকার হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোয় মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। ছোট ছোট চায়ের দোকানগুলোতে ফুরিয়ে যায় রুটি, বিস্কুট, কেক, কলা।
দোকানদাররা বলছেন, আমরা যে খাবার প্রস্তুত করেছি, তার তুলনায় চার গুণ মানুষ ভিড় ছিল। এ জন্য মুহূর্তেই খাবার শেষ হয়ে যায়। সমাবেশের আশপাশের এলাকায় হন্যে হয়ে খাবার খুঁজছিলেন মানুষজন। এ সময় খাবার না পেয়ে অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
আওয়ামী লীগের পর্যবেক্ষণ: সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নগরীর বেতপট্টিতে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বসে কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করেন নেতারা। মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়েও ছিল একই চিত্র।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু বলেন, আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিশ্বাসী। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠনের মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। তবে মিছিল ও সমাবেশের নামে কোনো রাজনৈতিক দল দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি, নাশকতা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে আওয়ামী লীগ প্রতিহত করার জন্য অতীতেও মাঠে ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
সমাবেশে আসা যুবদল নেতার মৃত্যু: সমাবেশে যোগ দিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কাহারোল উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমানের (৪৫) মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকেলে সমাবেশস্থলেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আখতারুজ্জামান জুয়েল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সকালে নেতাকর্মীদের নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান কাহারোল থেকে রংপুরের বিএনপির মহাসমাবেশে যোগদান করেন।-সমকাল
এবিসিবি/এমআই