রাষ্ট্রপতি অপসারণের শাসনতান্ত্রিক সংকট ও সমাধান
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন:
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে মোঃ সাহাবুদ্দিনের অপসারণ দাবি ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে জাতীয় জীবনে ঔৎসুক্য ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। বিশেষত এই দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে প্রায় নজিরবিহীন বিক্ষোভ এবং দাবির ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক দলের নানামুখী বক্তব্যে বিভ্রান্তি বাড়ছে বৈ কমছে না।
আমার মতে, এই সংকটের শুরু আরও আগে। গণঅভ্যুত্থানের পর দৃশ্যত রাষ্ট্র পরিচালনার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকায় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব। যেমন সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি। যেহেতু গত জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ছিল, সেহেতু সংসদ ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে মোটামুটি ঐকমত্য ছিল। কিন্তু স্পিকারের পদত্যাগের কোনো প্রয়োজন ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী বর্তমান স্পিকার পরবর্তী স্পিকার না আসা পর্যন্ত থাকতে পারতেন। কিন্তু স্পিকার না থাকায় বর্তমান সংকট আরও ঘনীভূত।
আবার নতুন সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড যেমন সংবিধান অনুযায়ী, তেমনই অনেক কর্মকাণ্ড সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সম্পাদিত হচ্ছে। ফলে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হলে সংসদ না থাকায় সংবিধান অনুযায়ী নতুন কোনো রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা যাবে না। ফলে বর্তমান রাষ্ট্রপতির অপসারণ সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে।
আমরা দেখেছি, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিন জোটের রূপরেখা ছিল এবং ওই রূপরেখা অনুযায়ী সবকিছু হয়েছিল। এইচএম এরশাদের কাছ থেকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, জাতীয় নির্বাচন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়া, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন– সবই হয়েছিল তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী। পরে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এসব পদক্ষেপকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। ফলে ওই সময় আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক কাজ, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে অস্থিরতা দেখা দেয়নি।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক বা অস্থায়ী সরকার নির্বাচন করে নির্বাচিত সংসদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কোনো রূপরেখা বা ঘোষণা আমরা দেখতে পাচ্ছি না, যে রূপরেখা বা ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি ও শাসনতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারে।
শাসনতান্ত্রিকভাবে বর্তমানে যে অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে জনসাধারণ যেমন অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, তেমনি আমরা যারা আইন পড়ি ও চর্চা করি, তারাও বুঝতে পারছি না কোন কাজটি সংবিধান অনুযায়ী আর কোনটা ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী হচ্ছে। যেমন দল বেঁধে গিয়ে বা বিক্ষোভ করে বিচারক, শিক্ষক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের পদত্যাগের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার বিষয়টি আমরা কোন শ্রেণিতে ফেলব?
যাই হোক, ছাত্র-জনতার আগস্ট অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের অনন্য ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে জনগণ নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। রাষ্ট্র সংস্কার করে একটি জনবান্ধব কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শত শত তরুণ আত্মাহুতি দিয়েছে। কিন্তু এই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কোনো রূপরেখা বা ঘোষণা না থাকায় যে শাসনতান্ত্রিক বাধা-বিপত্তি তৈরি হচ্ছে, সেটা কেবল রাষ্ট্রপতির অপসারণে সুরাহা হবে বলে মনে হয় না।
উল্লেখ্য, ১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়, তখন তারা আমেরিকান ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স প্রণয়ন করে এবং সে অনুযায়ী তাদের স্বাধীনতার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ১৭৮৯ সালে যখন ফরাসি বিপ্লব হয়, তখনও বিপ্লবীরা প্রণয়ন করেন জগদ্বিখ্যাত দ্য ডিক্লারেশন অব রাইটস অব মেন অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দেশের প্রথম সরকার ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণয়ন করে দ্য ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স, যা অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে কাজ করে এবং সে অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের রূপরেখা বা ডিক্লারেশন থাকলে সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারত।
প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে শেষ পর্যন্ত যদি অপসারণ করাই হয়, তাহলে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে কীভাবে? সংসদ না থাকায় সংবিধান অনুযায়ী সেটা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, শিক্ষক, আইনজীবী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর কনভেনশন ডাকতে হবে। সেখানকার মতামতের ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করা যেতে পারে। সবাইকে, বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, পরবর্তী সংসদে এর বৈধতা দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি ওঠার পর আমরা দেখলাম যে মধ্যপন্থি ও বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। মঙ্গলবার বিএনপির পক্ষ থেকে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দিয়েছে– বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়া হলে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে। এটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি ও বর্তমান সরকারের সমর্থক বিএনপি রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিরোধিতা করছে কেন? উত্তরে বলা যেতে পারে, বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ার আশঙ্কায়। কেবল বিএনপি নয়; মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক ও বামপন্থি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোও এই ভয় পেতে পারে। নির্বাচনী রোডম্যাপ এখন পর্যন্ত না দেওয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পাওয়ার প্রধানতম দাবিদার বিএনপি আগে থেকেই সতর্ক ও সচেতন অবস্থায় ছিল। নতুন করে কোনো ধরনের অস্থিরতা তারা স্বাভাবিকভাবেই চাইছে না।
যাই হোক, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ছাত্র-জনতার বিপুল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সরকার ক্ষমতাসীন, তারা দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও অর্থনীতির কিছু মৌলিক সংস্কার করে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ নেবে। এতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা এগিয়ে যাবে এবং জনবান্ধব কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সামষ্টিক প্রচেষ্টা বেগবান হবে।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক