মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের:বেনজীর, র্যাবপ্রধানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। নিষেধাজ্ঞায় থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং সাবেক মহাপরিচালক, বর্তমানে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ রয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম।
নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত অন্য কর্মকর্তারা হলেন- খান মোহাম্মদ আজাদ (র্যাবের বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স), তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, জুন ২০১৯-মার্চ ২০২১), মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, সেপ্টেম্বর ২০১৮-জুন ২০১৯), মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, এপ্রিল ২০১৬-সেপ্টেম্বর ২০১৮) এবং র্যাব-৭-এর সাবেক কমান্ডার মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ।
এর মধ্যে বেনজীর আহমেদ ও মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন না।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও অর্থ দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অর্থ দপ্তরের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল অফিস (ওএফএসি) বিভিন্ন দেশের ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট। এতে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনের শেষ দিনে এ নিষেধাজ্ঞা এলো।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ সরকারের নির্বাহী আদেশের আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এতে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয়েছে।
অর্থ দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি ওয়ালি আডেয়েমো জানিয়েছেন, এ নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাজ্য ও কানাডার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
তিনি বলেন, এ পদক্ষেপ একটি বার্তা দিচ্ছে যে, যারা নিপীড়ন চালাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলো কথা বলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক বিবৃতিতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার জন্য বেনজীর আহমেদ ও মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে।
এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ফলে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ধরনের বিনিয়োগ করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সম্পদ থাকলে তা জব্দ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিকের সঙ্গে তাদের আর্থিক লেনদেন নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণ সম্পর্কে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, র্যাব আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে হুমকিতে ফেলেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের এনজিওগুলো অভিযোগ করেছে, র্যাব এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০-এরও বেশি লোকের গুম ও নির্যাতনের জন্য দায়ী।
নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সমকালকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা গণমাধ্যমের কাছ থেকে জেনেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে সবকিছু জানার পর আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব।’
অন্যদিকে বিবিসি বাংলাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, তিনি এখনও বিজ্ঞপ্তিটি দেখেননি। দেখার পর প্রতিক্রিয়া জানাবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বেনজীর আহমেদ ও মিফতাহ উদ্দিন আহমেদসহ সাতজনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কারণ- টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হকের বিচারবহির্ভূত হত্যা। ২০১৮ সালের ওই হত্যাকাণ্ডের সময় বেনজীর আহমেদ র্যাবের প্রধান এবং মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ র্যাব-৭-এর কমান্ডার ছিলেন।
জানা গেছে, রথ্যাবের সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে গত বছরের অক্টোবরে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি।
১০ সদস্যের কমিটির পক্ষ থেকে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও অর্থমন্ত্রী স্টিভেন নুখিনের কাছে পাঠানো চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়, বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’ করার সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে।
চিঠিতে অভিযোগ তোলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি গুম এবং নির্যাতনের মতো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও রথ্যাবের সিনিয়র কর্মকর্তারা কোনো শাস্তির সম্মুখীন হননি।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে মার্কিন সিনেটরদের চিঠিতে অভিযোগ তোলা হয়, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ অভিযানকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর ইচ্ছাকৃত পদ্ধতি’ বলে মনে হয়।
চিঠিতে অভিযোগ তোলা হয়, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়টি মাথায় রেখে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানালেও রথ্যাব তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।
রথ্যাবের ‘পরিচালিত’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রায় সবগুলোর কারণ হিসেবে ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে উল্লেখ করা হলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রমাণ পায়নি বলে অভিযোগ তোলা হয় চিঠিতে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে অভিযোগ তোলা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই ‘বন্দুকযুদ্ধের সাক্ষীদের জোরপূর্বক মিথ্যা সাক্ষ্য’ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত অনেকেই কিছুদিন অথবা কয়েক মাস আগে গুমের শিকার হয়েছিলেন।