বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় ‘উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা’ রয়েছে

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার বিষয়ক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ থাকলেও সরকার অনেক ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং দেশটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার “উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা” রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ২০২০ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ৩০শে মার্চ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে – তাতে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, অনেক সাংবাদিক সরকারের হয়রানি ও নিপীড়নের ভয়ে স্ব-প্রণোদিত হয়ে সরকারের সমালোচনার করার বিষয়ে নিজেদের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সাথে তুলনা করা হয়- যার সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে।
প্রতিবেদন বলছে, আইনে ‘হেইট স্পিচ’ বা ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও একে যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যার কারণে সরকার একে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
“সরকার যদি কোন বক্তব্যকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায় বা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কে প্রভাব ফেলে বলে মনে করে, অথবা জনশৃঙ্খলা-নৈতিকতা-শালীনতার পরিপন্থী, বা আদালত অবমাননাকারী বা অপরাধে প্ররোচনাদানকারী বলে মনে করে – তাহলে সরকার মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে ।”
এতে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির সময় সরকার ২০১৮ সালে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে মহামারি মোকাবেলায় সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে।
“এছাড়া অন্যভাবেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। এপ্রিলে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। “
মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে কমপক্ষে ১৯জন সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং অন্য নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই আইনের আওতায় মামলা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগ এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা সাংবাদিকদের উপর শারীরিক হামলা, হয়রানি, বা ভয় দেখানোর মতো কাজ করেছে। এই আইনকে মানবাধিকার কর্মীরা – সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে দেখেন।
এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় সরকার ইন্টারনেট যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করা, ফিল্টার কিংবা ব্লক করার মতো পদক্ষেপ নিয়ে থাকে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
“নিরাপত্তার কারণ” দেখিয়ে গত বছর রোহিঙ্গা শিবিরে থ্রিজি এবং ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আল-জাজিরা, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ রাখার বিষয়গুলোও উঠে আসে। শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।

মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকার বা এর এজেন্টদের হাতে বিচার বহির্ভূত ও বেআইনি হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও বেআইনিভাবে আটক রাখা, দুর্নীতি, এবং মত প্রকাশে বাধাদানের মতো ইস্যুগুলো।
বিস্তারিত এই প্রতিবেদনটিকে ৭টি মূল সেকশনে ভাগ করা হয়েছে যেখানে গুরুত্ব পেয়েছে নির্যাতন, কারাগারের বৈরী পরিস্থিতি, বেআইনিভাবে আটক, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, সহিংসতা, বেআইনিভাবে সাংবাদিক ও মানবাধিকার-কর্মীদের গ্রেফতার, সেন্সরশিপ আরোপ, সাইট ব্লকিং, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও সংগঠনের অধিকার হরণ, চলাচলের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, নারী ও মেয়েদের বিরৃদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ ও সহিংসতা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি সহিংসতা ও হুমকি, সমকামীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, শ্রমিক সংগঠন ও ইউনিয়নে গঠনে কঠোরতা এবং শিশু শ্রমের মতো বিষয়গুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়মুক্তি দিয়ে থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে খুব কম পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হলেও নির্বিচার ও বেআইনিভাবে হত্যার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী দেশে গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ১৯৬টি বিচার-বহির্ভূত হত্যা হয়েছে। ২০১৯ সালেএর সংখ্যা ছিল ৩৮৮ আর ১৮ সালে ছিল ৪৬৬টি।
মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজ এসব বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে যে, এদের মধ্যে অনেকেই নির্দোষ ছিল।
গত সেপ্টেম্বরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে, ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক রোহিঙ্গা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এসব রোহিঙ্গাকে “ভুক্তভোগী” হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি। তিনি বলেছেন, এরা সবাই অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ী ছিল – যারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছিল।
জুলাইয়ের ৩১ তারিখে কক্সবাজারে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। যেখানে বলা হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং এর জের ধরে পরবর্তীতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হত্যার দায়ে ২১ পুলিশ কর্মকর্তা বহিষ্কার এবং নয় জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এখনো নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম এবং অপহরণের মতো ঘটনা হয়। গত বছরের ১০ মার্চ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ফটো-সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল গুম হন। মে মাসে তার খোঁজ মিললেও তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা করা হয়। মোট ২৩৭ দিন কারাগারে থেকে অবশেষে ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান তিনি।
বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানে নির্যাতন নিষিদ্ধ হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়ার মতে, নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক সাজা দিয়ে থাকে।

গত সেপ্টেম্বরে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম একটি মামলার রায় দেয় যেখানে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন ও দুই জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বলা হয়, ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলেও ওই নির্বাচন মুক্ত ও অবাধ ছিল না এবং তাতে অনিয়ম হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন।
দুর্নীতি বাংলাদেশে এখনো মারাত্মক সমস্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আইনে শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার থাকলেও শ্রমিক সংগঠন হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার শর্ত কঠোর বলে উল্লেখ করা হয়। বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নথিভূক্তির শর্তের অপব্যবহার করা হয়। কারণ ছাড়াই বাতিল করা হয় নথিভুক্তির আবেদনও।
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা ইপিজেড এর প্রায় ৫ লাখ শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আইনের মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ সংস্থাগুলো বেশিরভাগ সময়েই বেপজার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় – যার কারণে স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন সম্ভব হয় না।
সলিডারিটি সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের পর থেকে ইউনিয়ন নথিভুক্ত করা ও অনুমোদনের জন্য আবেদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
২০১৮ সালে করা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের এক জরিপে দেখা যায় যে, ৯৭.৫ ভাগ গার্মেন্টস শ্রমিক কোন শ্রম ইউনিয়নের সাথে যুক্ত নন। ওই বছরেই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অবশ্য জানায় যে, তৈরি পোশাক শিল্পে ৯০৯টি ট্রেড ইউনিয়ন এবং ১৬০৯টি কমিটি রয়েছে।
এছাড়া শ্রমিকদের আন্দোলন উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে ২৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকল বন্ধের বিষয়টিও উঠে আসে।
এছাড়া জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যৌন শোষণের মামলা ও অভিযোগের তেমন তদন্ত না হওয়া, ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত সরকারি সহযোগিতা ও নিরাপত্তা না দেয়ার মতো অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
তৈরি পোশাক ও চিংড়ি শিল্প ছাড়া সব সেক্টরেই শিশু শ্রম রয়েছে বলে জানানো হয়। সেই সাথে মজুরী বৈষম্য, গ্রহণযোগ্য কর্ম-পরিবেশের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। বিবিসি