প্রেসিডেন্ট বাইডেন কেন ‘না’ বললেন ইসরায়েলকে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একজন স্বঘোষিত ‘জায়নবাদী’। ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য তিনি গলদঘর্ম। তবে আকস্মিকভাবে তিনি ইসরায়েলে বোমার বড় ধরনের সরবরাহ স্থগিত করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। এই প্রথম তিনি ইসরায়েলকে সরাসরি ‘না’ বললেন। কিন্তু কেন তিনি এ কাজ করলেন?
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, বাইডেন ইসরায়েলকে তাঁর বার্তা বোঝাতে পারছিলেন না। ফোনালাপ, দূত পাঠিয়ে অথবা প্রকাশ্য বিবৃতি বা যৌথ কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে তাঁর বার্তা যেন ইসরায়েলে পৌঁছাচ্ছিল না। ইসরায়েল তাঁকে উপেক্ষা করে আসছে। অবশেষে হতাশ হয়ে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির কর্ণধার ইসরায়েলি নেতাদের কাছে নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য আরও নাটকীয় উপায় বেছে নেন। তিনি বোমা পাঠানো বন্ধ করে দেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন আশা করছেন, ৩ হাজার ৫০০ বোমা সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ইসরায়েলকে গাজায় তাদের যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করতে প্রভাবিত করবে। সাত মাস আগে গাজায় আগ্রাসন শুরুর পর বাইডেন প্রথমবারের মতো তাঁর অসন্তোষ প্রদর্শনের জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন।
বোমা সরবরাহের পাশাপাশি বাইডেন আরও বলেছেন, গাজার রাফাহতে ইসরায়েল বড় ধরনের স্থল অভিযান চালালে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেছেন, ‘যদি তারা রাফাহতে হামলা চালায়, তাহলে সেখানে এখন পর্যন্ত যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, এমন অস্ত্র আর আমরা সরবরাহ করব না।’
তবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করা অব্যাহত রাখবে বলেও একই সময় জানিয়েছেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ইসরায়েল গাজার বেসামরিক মানুষ হত্যায় ব্যবহার করেছে বলে স্বীকার করেছেন বাইডেন।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, বোমা আটকে রাখার সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মধ্যে ৭৬ বছরের সম্পর্কের একটি টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু এটা ‘ব্রেকিং পয়েন্ট’ নয়। বাইডেন প্রশাসন এখনও বেশির ভাগ অন্যান্য অস্ত্র ইসরায়েলে পাঠানোর অনুমতি দিচ্ছে। বাইডেন বলেছেন, ‘আমরা ইসরায়েলের নিরাপত্তা থেকে সরে যাচ্ছি না; আমরা রাফাহতে ইসরায়েলের যুদ্ধ করার ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় অনবরত বেসামরিক লোকের মৃত্যু ও মানবিক পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি হওয়ায় ইসরায়েলি অভিযানে লাগাম টানতে ডেমোক্র্যাট ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
ইউরেশিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান ক্লিফ কুপচান বলেছেন, বোমা সরবরাহ স্থগিতের সিদ্ধান্তের অর্থ হলো, নেতানিয়াহুর ওপর বাইডেন তাঁর একমাত্র আসল ক্ষমতাকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ছাড়া বাইডেনের কোনো উপায় ছিল না। গাজা যুদ্ধ তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা, ডেমোক্রেটিক পার্টির ঐক্য এবং বিশ্বে মার্কিন অবস্থানের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে।
ওয়াশিংটন ডিসির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ক্যাটো ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ডগ ব্যান্ডো আলজাজিরাকে বলেছেন, বাইডেন খুব গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করছেন। তাঁর দলে অনেক তরুণ প্রগতিশীল রয়েছেন, সেই সঙ্গে আরব-আমেরিকানরা গাজায় তাঁর অবস্থান এবং ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের ব্যাপারে ভীষণ ক্ষুব্ধ। নভেম্বরে তাদের ভোট হারানো নিয়ে চিন্তিত বাইডেন।
সামগ্রিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ইসরায়েলকে বেশি সাহায্য দিয়েছে। কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের মতে, ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে ১৫৮.৭ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করেছে। এর বিশাল অংশই সামরিক ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার জন্য। ওয়াশিংটন বর্তমানে বছরে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা প্রদান করছে। এর বাইরে গত মাসে কংগ্রেস ইসরায়েলকে ১৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব পাস করেছে এবং বাইডেনও তা অনুমোদন করেছেন।
ইসরায়েলে ক্ষোভ-হতাশা
অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার বাইডেনের হুমকি ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে বলে জানায় সিএনএন। তবে বাইডেনের পরোক্ষ সমালোচনা করে ইসরায়েলের কট্টরপন্থি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইসরায়েলকে একা দাঁড়াতে বাধ্য করা হলে, ইসরায়েল তাই করবে।’
ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ জানায়, দেশটির প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা মনে করেন, মার্কিন অস্ত্রের চালান আটকে রাখা গাজা যুদ্ধকে প্রভাবিত করবে না। তবে অন্যান্য ফ্রন্টে সামরিক প্রস্তুতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
কর্মকর্তারা ইসরায়েলি সরকার এবং বাইডেন প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির বিষয়েও উদ্বিগ্ন। তারা সতর্ক করে বলেছেন, বোমা সরবরাহ স্থগিত রাখা দুটি মিত্রের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এবিসিবি/এমআই