দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের আরো অবনতি

দুর্নীতির ধারণা সূচকে আগের বছরের তুলনায় আরো দুই ধাপ নীচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ।
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’ এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
যদিও এই ব্যাখ্যার কোন সত্যতা নেই বলে দাবি করছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
সিপিআই ২০২০ অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নীচের দিক থেকে বাংলাদেশ ১২তম অবস্থানে আছে।
যেটা সিপিআই-২০১৯ এর তুলনায় দুই ধাপ নীচে নেমেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৯ সালে নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪ তম।
এর পেছনে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টিকে অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহিতার অভাবকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি।

এই সূচক এবং ব্যাখ্যা সঠিক নয়: দুদক
দুর্নীতি দমন কমিশনের দাবি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই সূচক এবং ব্যাখ্যা সঠিক নয়।
সংস্থাটির কমিশনার মোজাম্মেল হক খানের মতে, দুদকের কাজের প্রতি বাংলাদেশের ৬৮% মানুষ তাদের আস্থা প্রকাশ করেছে।
এছাড়া বাংলাদেশ এতোটা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে সাম্প্রতিককালের উন্নয়ন কাজে এতোটা সাফল্য পেতো না।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে জরিপ পরিচালনা করলে টিআই এর এমন প্রতিবেদন টিকবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মি. খান মনে করেন প্রত্যাশা বেশি হওয়ার কারণে তাদের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ দুর্নীতির ধারণা সূচকে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে।
এ ব্যাপারে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের যদি প্রত্যাশিত অগ্রগতি হতো তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও দুই থেকে তিন শতাংশ বেশি হতো।
২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বছর বাংলাদেশ, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে টিআই প্রতিবেদনে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়ে আসতে থাকে।
তবে টানা তিন বছর বাংলাদেশের স্কোর ১০০ এর মধ্যে ২৬-এ আটকে আছে।
সূচকে বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থান
১০০ এর মধ্যে ৪৩ স্কোরকে গড় স্কোর হিসেবে বিবেচনায় সিপিআই ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ২৬। যা সিপিআই ২০১৮ ও ২০১৯ এর তুলনায় অপরিবর্তিত রয়েছে।
এছাড়া সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম।
এক্ষেত্রেও ২০১৯ এর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।
দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের এই অবস্থান হতাশাব্যাঞ্জক বলে উল্লেখ করেছেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।
এই স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক বলে তিনি জানান।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ তালিকার নীচের দিক থেকে শুধু পিছিয়েছে তাই নয় বরং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে একমাত্র আফগানিস্তানই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত।
অর্থাৎ দুর্নীতির সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শুধুমাত্র আফগানিস্তানের আগে। অন্যদিকে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ শুধুমাত্র কম্বোডিয়া, আফগানিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার চাইতে এগিয়ে আছে।
এছাড়া টিআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের সমান ২৬ স্কোর পেয়েছে উজবেকিস্তান এবং গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো। এই দুটো দেশই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসেবে বাংলাদেশের চাইতে পিছিয়ে আছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চিত্র
সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান, দেশটির স্কোর ৬৮। ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার ওপর থেকে এই দেশটির অবস্থান ২৪তম।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে এই দ্বীপ দেশটি। এক বছরের মাথায় দেশটি ৫৫ ধাপ উন্নতি করেছে। অর্থাৎ ১৩০তম অবস্থান থেকে ৭৫তম অবস্থানে উঠে এসেছে।
মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে শুধুমাত্র ভুটান ও মালদ্বীপ গড় স্কোর ৪৩ করতে পেরেছে।
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটির স্কোর ৪০। তালিকার ওপর থেকে দেশটির অবস্থান ৮৬তম। ২০১৯ সালের তুলনায় ভারতের অবস্থান ৬ ধাপ এগিয়েছে।
ভারতের পরেই রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। এরমধ্যে শ্রীলঙ্কা আগের চাইতে ১ ধাপ পিছিয়ে ৯৪তম অবস্থানে আছে। নেপাল ৪ ধাপ পিছিয়ে আছে ১১৭তম স্থানে।
বাংলাদেশের ঠিক আগেই পাকিস্তানের অবস্থান। ২০১৯ সালের চাইতে দেশটি এক ধাপ পিছিয়েছে। দেশটির স্কোর ৩১। তালিকার ওপর থেকে এর অবস্থান ১২৪ তম।
সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ
গতবারের মতো এবারও বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক এবং নিউজিল্যান্ড। এই দুটি দেশের স্কোর ৮৮। অন্যদিকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হল সাউথ সুদান এবং সোমালিয়া। দেশ দুটির স্কোর ১২।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সিঙ্গাপুর। দেশটির স্কোর ৮৫। সে হিসেবে দেশটি দ্বিতীয় অবস্থানে আছে।
মিয়ানমারও তার আগের অবস্থানের চাইতে ১৩ ধাপ উপরে উঠে এসেছে।
অন্যদিকে রাশিয়া মাত্র ৩০ স্কোর পেয়েছে, চীন পেয়েছে ৪২ স্কোর।
এবারের তালিকা অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে ১২১টি দেশ ৫০ এর নীচে স্কোর পেয়েছে। সিপিআই ২০১৯ এর তুলনায় ৪৮টি দেশের স্কোর কমেছে। অপরিবর্তিত আছে ৭০টি দেশের স্কোর এবং ৬২টি দেশের স্কোর বেড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী কোন দেশই সর্বোচ্চ স্কোর করেনি। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি বিরাজমান বলে জানান মি.ইফতেখারুজ্জামান।
মূলত রাষ্ট্রীয় খাতে ঘুষ লেনদেন, সরকারি অবস্থান ও সম্পদ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার, স্বজনপ্রীতি এবং রাষ্ট্রকাঠামোকে দখল করার প্রবণতাকে এই সূচকের বিবেচনায় আনা হয়েছে।
এছাড়া একটি দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা, তথ্য অধিকার ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক শুদ্ধাচার, দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচারের আওতায় আনা, সম্পদের তথ্য প্রকাশ, তথ্য প্রকাশকারীদের নিরাপত্তা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদিও এই সূচকের মূল বিষয় হিসেবে কাজ করে থাকে।

কারণ:
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারে অবদমন, রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহার, মত প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অভাব, বিচারহীনতা, সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ব্যাংকিং খাত ও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করে টিআইবি।
টিআইবি’র সুপারিশ
দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়ে নিতে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে টিআইবি।
- সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন।
- সামাজিক অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে সব দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা।
- রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে নিজেদের সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন।
- সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে এবং বেসরকারি খাতে বেনামি মালিকানা সেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনি কাঠামো জোরদার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বাড়ানো।
- জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও জাতীয় সংসদের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং এসব প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা।
- ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত রাখা। যতো ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন হয় সেটা শেয়ারিং-এর যে পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী চালু আছে, সেটাতে অংশ নেয়া। এতে আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও কর ফাকি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
- ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে তথ্য অধিকার আরও দ্রুত ও বিস্তৃত করা।
- সাধারণ মানুষ, এনজিও, গণমাধ্যম যেন জবাবদিহিতা চাইতে পারে সেই সুযোগ বাড়ানো। বিবিসি