‘গণতন্ত্র সুরক্ষিত নয়, এমন দেশ ইন্টারনেট বন্ধ রাখে’
চলমান কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় রাজধানীসহ সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সাময়িক বন্ধ করলেও এবার সব ধরণের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হতে দেখা যায়। টানা পাঁচ দিন ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু করা হলেও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা এখনো চালু করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, যে দেশগুলোতে গণতন্ত্র সুরক্ষিত নয় সেখানে ইন্টারনেট বন্ধ করতে বেশি দেখা যায়। এতে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার কারণ হিসেবে সরকার মহাখালী ডাটা সেন্টারে নাশকতাকে উল্লেখ করে।
এ ব্যাপারে ১৮ জুলাই ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা নিয়ে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাহায্য করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’ পরে তিনি তার বক্তব্যে আবার বলেছেন, ‘মহাখালীতে অবস্থিত ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে।’
যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘১৮ জুলাই মহাখালীতে দূর্যোগ ভবনে আগুন লাগলেও মহাখালী ডেটা সেন্টারের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। সারা দেশে এখান থেকে ৩০ শতাংশ ইন্টারনেট সেবা সরবরাহ করা হয়। এতে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো সম্পর্ক নেই।’
বিশ্বে অনেক সংস্থা রয়েছে যারা ইন্টারনেট সেবা বন্ধ-খোলা, পরিষেবা যাচাই ইত্যাদির ওপর নজর রেখে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারনেট সোসাইটি’ তেমনই একটি সংস্থা। তারা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবা গত ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৫ দিন ১২ ঘণ্টা যাবত পুরোপুরি বন্ধ ছিল। পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই মঙ্গলবার রাত প্রায় দশটা থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে অটল থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সীমিত পরিসরে চালু করা হয়। ফেসবুক এখনো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম সেবা এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
‘ইন্টারনেট সোসাইটি’র মতে, ইন্টারনেট বন্ধ সবসময় মানবাধিকারের ওপর আক্রমণ। যখন মানুষ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, এটি জীবনের সমস্ত দিককে প্রভাবিত করে- কাজ, শিক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবা ও ব্যাংকিং পর্যন্ত। শাটডাউন সাংবাদিকতাকে অবরুদ্ধ করে, স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং সম্প্রদায়ের আয়োজনকে সীমাবদ্ধ করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ডকুমেন্টেশন প্রতিরোধ করে। সংঘাত এবং সঙ্কটের সময়, দেশের সরকার মানুষকে জীবন রক্ষাকারী তথ্য এবং মানবিক সহায়তা অ্যাক্সেস করা থেকে বিরত রাখে।
গত ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তাদের একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ করা সরকারের একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সাংবিধানিক অধিকার। তথ্য ও মতপ্রকাশকে বাধা দিয়ে বহির্বিশ্ব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক ছোঁড়া গুলিতে হতাহত খুবই উদ্বেগজনক। এর বিচার সময়ের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।’
আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম ‘কিপইটঅন’ একটি ডিজিটাল প্লাটফর্ম যা বিশ্বের ইন্টারনেট পরিষেবা পর্যবেক্ষণ নিয়ে কাজ করে। ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে তাদের সবশেষ ২০২৩ ও ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২৩ সালে তিন বার ঢাকার নয়া পল্টনে সরকার মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে রাখে। ২০২২ সালে ছয় বার ঢাকার নিউমার্কেট, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা সিটিতে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখতে দেখা গেছে। ২০২২ সালে কে বা কারা ইন্টারনেট বন্ধ করেছে তা অজানা উল্লেখ করা হয়। তা ছাড়া ২০২২-২০২৩ সালের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতে সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট সেবা বার বার বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
ক্লাউডফ্লেয়ারের আউটেজ সেন্টার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইটে ঢুকলে প্রথমেই দেখা যায় সিরিয়ায় ইন্টারনেট বিভ্রাটের বিষয়টি। যেখানে দেখা যায়, সিরিয়ায় গত ২৫ জুলাই পুরো দেশে কয়েক ঘণ্টার জন্য সরকারের নির্দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে রাখা হয়। এরপরেই বাংলাদেশেরটা দেখা যায় যেখানে উল্লেখ করা হয়, ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। বন্ধের কারণ হিসেবে সরকার কর্তৃক নির্দেশ করা উল্লেখিত। ২৩ জুলাই এর রিপোর্ট অনুযায়ী এখানে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ধীরে ধীরে কানেক্টিভিটি ফিরে আসছে। ৫ দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকাতে তাদের নেটলস ক্যালকুলেটর অনুমান করে যে, এই বন্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ২১৯ লক্ষ ৬৫ হাজার ২২২ মার্কিন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে। ইন্টারনেটের এমন শাটডাউন চলতে থাকলে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতিদিন আরও ৩৫ লক্ষ মার্কিন ডলারের বেশি ক্ষতি হবে।
ইন্টারনেট বন্ধে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে অনলাইন ভিত্তিক ই-কমার্স ও ফ্রিলান্সাররা। গ্রাফিক ডিজাইনার আহসান একজন ফাইন আর্ট গ্র্যাজুয়েট যিনি বাংলাদেশের ৬৫০,০০০ ফ্রিল্যান্সারদের একজন। ২৬ জুলাই শুক্রবার রইটার্সের একটি প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘স্বাধীন পেশাজীবীরা যারা ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে কাজ খুঁজে পান তারা এখন চিন্তিত যে তাদের নামিয়ে দেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে যারা নিয়মিত পরিষেবা প্রদান করে যেমন অনলাইন মার্কেটিং তারা সপ্তাহব্যাপী বিভ্রাটের পরে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক হারিয়ে ফেলতে পারে। আমি আমার ক্লাইন্টকে শেষ মুহূর্তেও আমার কাজ ডেলিভারি দিতে পারিনি। এতে আমার ওপর তাদের বিশ্বস্ততা কমে গিয়েছে।’