কোটা আন্দোলনে শুক্রবার সকাল থেকে উত্তপ্ত ঢাকা

শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকার নানা জায়গায় বিক্ষোভকারীরা শক্ত অবস্থান নেন
কোটা-বিরোধী আন্দোলন ও সহিংসতায় শুক্রবার সকাল থেকে আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা। সহিংসতা ছড়িয়েছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকার বাড্ডা, নতুনবাজার, রামপুরা, গুলশান, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এলাকায় বিক্ষোভকারীরা সকাল থেকেই সড়কে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি সংঘাত হয়েছে বাড্ডা-নতুনবাজার-রামপুরা সড়ক এবং যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সকাল সাড়ে দশটা থেকে প্রায় সাড়ে বারোটা পর্যন্ত পুলিশের সাথে সংঘর্ষের তীব্রতা ছিল সবচেয়ে বেশি। এ সময় মুহুর্মুহু সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, ককটেল ও গুলির শব্দ শোনা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এটা দুঃখের, নো ডাউট অ্যাবাউট ইট (এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই)। এটা অত্যন্ত দুঃখের। আমি এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই সহিংসতা কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা করে নাই। এটা আমার বিশ্বাস হয়না।”

ঢাকার পরিস্থিতি কেমন?
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নতুন বাজার এলাকায় পুলিশকে গুলি করতে দেখেছেন বিবিসি সংবাদদাতারা। সংঘর্ষের তীব্রতা এতো বেশি ছিল যে পুলিশ এক পর্যায়ে পিছু হঠে যায়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তব্যরত পুলিশকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আরো গুলি সরবরাহ করার অনুরোধ করতে শোনা যায়।
এই এলাকায় সংঘাতের সময় হতাহতের খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে গুলিবিদ্ধ এক তরুণকে গুলশানে শিকদার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আনা হয়। এসময় বিবিসির সংবাদদাতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
আহত তরুণকে যখন হাসপাতালে আনা হয় তখন প্রধান ফটক বন্ধ ছিল। হাসপাতালে তাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। এসময় আহত ব্যক্তির সাথে থাকা ১০-১২ জন এবং আশপাশের মানুষজন সেটির প্রতিবাদ জানায়।
এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা হাসপাতালের ফটকে আঘাত করে। এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ঢুকতে দেয় কর্তৃপক্ষ।
বাড্ডা-নতুন বাজার সড়কের পাশেই কূটনীতিক এলাকা অবস্থিত। সেখানে কাছাকাছি দূরত্বে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং কানাডা-সহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রয়েছে।
সংঘর্ষের সময় কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা রক্ষার জন্য পুলিশ পুরো এলাকায় শক্ত অবস্থান নেয় এবং যান চলাচল ও মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়।
বনশ্রী এলাকা থেকে একজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, সেখানে আবাসিক এলাকায় ভেতরে সকালে একাধিক মিছিল দেখা গেছে, যেখানে তারা কোটা বাতিলের দাবিতে স্লোগান দেয়।
বড় আকারে সংঘাতের আরেকটি জায়গা ছিল ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকা। সেখানে পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত বুধ ও বৃহস্পতিবারের মতোই তীব্র ছিল।
যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে একজন সাংবাদিক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট এবং টিয়ারশেল ছুঁড়েছে। সংঘাতের সময় পুলিশ ও বিক্ষোভকারী উভয় পক্ষই আহত হয়েছে বলে তিনি জানান।
সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত অবস্থায় কয়েকজনকে দেখা গেছে। তবে হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ঢাকার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, টাউন হল এলাকায় গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় বিভিন্ন বস্তুতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার একজন বাসিন্দা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও ছিলেন। এসময় বিক্ষোভকারীদের সাথে কিছু পরিবহন শ্রমিকও যোগ দিয়েছিল বলে তিনি জানান।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে গুলশান এভিনিউতে বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘাত হয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা গুলশান এক নম্বর মোড়ে বেশ কয়েকটি ভবনের কাঁচ ভাঙচুর করে। এসময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল মেরে বিক্ষোভকারীদের হঠিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারী গুলশান শুটিং ক্লাব এবং গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডে অবস্থান নেয়।
রাজধানী ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সংঘাতের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া সাভার থেকেও সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে।

সরকার অপেক্ষা করছে আলোচনার জন্য
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার জন্য সরকার অপেক্ষা করছে।
“আমি নিশ্চিত তারাও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছেন যে তারা আলোচনায় আসবেন না। তারা যখন যে সময় আলোচনায় আসতে চান আমরা তখনই আলোচনায় বসতে রাজি আছি। ”
আন্দোলনকারীদের সাথে সরকারের তরফ থেকে সরাসরি কোনও যোগাযোগ করা হয়েছে কি না?
বিবিসি বাংলার এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “সরাসরি যোগাযোগ করার তো প্রশ্ন আসে না। মিডিয়ার মাধ্যমে সে বার্তা দেয়া হয়েছে। এটা তো আমরা পাবলিকলি বলে দিয়েছি।”
আন্দোলনকারীরা সরকারের আলোচনার আহ্বান ইতোমধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে সংঘাতও অব্যাহত আছে।
এখনও পর্যন্ত ৩২ জন নিহত হবার খবর নিশ্চিত করেছে বিবিসি বাংলা। এরমধ্যে মঙ্গলবার ৬ জন, বৃহস্পতিবার ২৫ জন এবং শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত একজন নিহত হয়েছে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, পুলিশ অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে তাদের হঠিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি হল?
“পুলিশ গতকাল কোনও শক্তি প্রয়োগ করে নাই। যখন নাশকতা হয় তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তব্যই হচ্ছে নাশকতা বন্ধ করা”, বলেন আইনমন্ত্রী।
পুলিশ শক্তি প্রয়োগ না করলে বৃহস্পতিবার এতো মানুষ নিহত হল কেন? এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমি এই ফিগারের (সংখ্যা) সাথে ঐকমত্য পোষণ করতে পারছি না। পুলিশ কালকে কোনও গুলি চালায় নাই, পুলিশের গুলিতে কেউ নিহত হয় নাই।”
আন্দোলনকারীরা বলছেন, সরকার একদিকে আলোচনার কথা বলছে অন্যদিকে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ তাদের ওপর হামলা করছে। এতো মানুষের নিহত হবার পর তারা আলোচনায় যেতে পারেন না বলে উল্লেখ করেছেন আন্দোলনকারীরা।
কোটা বিরোধীদের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা রাস্তায় সক্রিয় রয়েছে। তারা রাস্তায় সক্রিয় হল কেন?
“একটা পক্ষ কোটা বিরোধী আন্দোলন করছে। আরেকটা পক্ষ তো কোটা সমর্থন করতে পারে। পারে না? এটা তো গণতান্ত্রিক দেশ। তো তারা সেটা করেছে,” বলেন আইনমন্ত্রী।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ অনুযায়ী বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আপিল বিভাগে কোটা নিয়ে শুনানি এগিয়ে আনার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
ছবির উৎস,AFP
ইন্টারনেট বন্ধে ভোগান্তি
এদিকে বিক্ষোভ ঠেকানোর জন্য সরকার নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে। বুধবার রাত সাড়ে আটটার থেকে পুরো বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাপক ভোগান্তি তৈরি হয়েছে।
ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনলাইনে আর্থিক লেনদেন কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে যেসব যেসব লেনদেন হয় সেখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বিকাশ-এর একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানান, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে তাদের লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে।
“শর্টকোড ব্যবহার করে বিকাশ-এ লেনদেন করা যায়। কিন্তু বহু গ্রাহক অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন করেন। ইন্টারনেট না থাকায় অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন করা যাচ্ছে না”, বলছিলেন ওই কর্মকর্তা।
যাদের পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তাদের সাথে যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি তাদের পরিবারের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগের জন্য ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো এবং আরো নানা ধরনের ইন্টারনেট-ভিত্তিক অ্যাপ ব্যবহার করেন। এছাড়া সংবাদমাধ্যমও কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
ছবির উৎস,AFP
সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
শুক্রবার সকাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ঢাকা শহরে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
কিন্তু তারপরেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে বিকেলে তারা ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশ করবে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন-মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও শুক্রবার ঢাকায় সমাবেশ করার কর্মসূচী ঘোষণা দিয়েছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু পুলিশ নিষেধাজ্ঞা দেবার পর দলটি সমাবেশ করবে কি না সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত আসেনি।
এদিকে সকালে বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রুহুল কবির রিজভীকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
-
- বিবিসি