উপলব্ধি না হলে অতীতের স্বৈরশাসকদের পরিণতি: মির্জা ফখরুল

কোনো গণআন্দোলন ব্যর্থ হয়নি, এবারও হবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, এখনও যদি সরকারের উপলব্ধি না হয়, তাহলে অতীতের স্বৈরশাসকদের মতো পরিণতি হবে। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবাধিকার আদায়ের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্যায়ের সমর্থন আছে বলেও জানান তিনি। মহাসমাবেশে বাধাবিঘ্ন না ঘটিয়ে জনগণের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় উদ্ভূত পরিস্থিতির দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
বিএনপির আজকের মহাসমাবেশ সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে সমাবেশ থেকে জনসম্পৃক্ত নানা কর্মসূচি দেবেন বলেও জানান তিনি। বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো হুমকি-ধমকি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সরকারের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে ন্যায় ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সাক্ষাৎকারে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের কঠোর অবস্থান, পরবর্তী কর্মসূচি, বিদেশিদের ভূমিকাসহ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন তিনি।
সমকাল : অনেকে মনে করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির কারণে বেশ কিছুদিন বিরোধী দলের নেতাকর্মী ধরপাকড় ও সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় ছিল সরকার। এবার মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আবার গণগ্রেপ্তার চালিয়েছে পুলিশ। তাহলে সরকার কি আবার ‘হার্ডলাইনে’ ফিরে গেছে?
মির্জা ফখরুল : এ সরকারের চরিত্র এতটুকু বদলায়নি। তারা একটি অনির্বাচিত সরকার। জোর করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে যেভাবে হোক ক্ষমতায় টিকে থাকা। তারা জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সে কারণে জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আজকে বিরোধী দল যে আন্দোলন করছে, তা শান্তিপূর্ণভাবে করছে। তাদের সাংবিধানিক যে অধিকার রয়েছে তা আদায়ের জন্য আন্দোলন করছে। আন্দোলনের লক্ষ্যই হচ্ছে– সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এটা মৌলিক অধিকার। এ অধিকার চর্চার সামান্যতম সুযোগ দিচ্ছে না সরকার। বরং ব্যাপকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। বিভিন্ন অজুহাতে বাড়িঘর, হোটেল-রেস্তোরাঁয় তল্লাশি চালিয়ে গ্রেপ্তার করছে। দেশে একটি ভীতির রাজ্য তৈরি করেছে। এটা কোনো সভ্য দেশে গণতান্ত্রিক সরকার করতে পারে না। তারা যে একটা ফ্যাসিবাদী সরকার, সেটাই প্রমাণ করছে। এগুলো করে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে বলে মনে করছে তারা। আবারও একই কায়দায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। এটাই হলো তাদের লক্ষ্য। কিন্তু জনগণ এটা মেনে নিচ্ছে না। জনগণ স্রোতের মতো প্রতিটি সমাবেশে আসছে, সম্পৃক্ত হচ্ছে এবং তাদের মতামত প্রকাশ করছে।
সমকাল : নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে সেপ্টেম্বর মাসে ‘চল চল ঢাকা চল’ কর্মসূচি দিয়ে ‘ঢাকা ঘেরাও’-এর মতো চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবে বলে গুঞ্জন ছিল। হঠাৎ আগস্ট মাসেই চূড়ান্ত আন্দোলনের ঢাকামুখী কর্মসূচি এগিয়ে আনার কারণ কী?
মির্জা ফখরুল : কোনো সুনির্দিষ্ট সময়ের কথা আমরা বলিনি। আমাদের কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় কাজ করছি। আমরা মনে করছি, মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছে। কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেই কর্মসূচি দিয়েছি। আগের কর্মসূচি ছিল তরুণদের। এটা মূল রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের কর্মসূচি।
সমকাল : অনেকে মনে করছেন, সরকার আগাম নির্বাচন নিয়ে তফসিল ঘোষণা দিতে পারে। সে আশঙ্কা থেকেই আপনারা পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছেন। গত ২২ জুলাই তারুণ্যের সমাবেশের চার দিনের ব্যবধানে মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছেন– এর মাধ্যমে কি চূড়ান্ত কর্মসূচিতে চলে গেলেন?
মির্জা ফখরুল : ভোটারবিহীন নির্বাচন করার চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র তারা করতেই পারে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতাসহ সব কিছু মাথায় রেখেই কর্মসূচি প্রণয়ন করছি। আমরা ইতোমধ্যে এক দফা কর্মসূচিতে আন্দোলন শুরু করেছি। এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। তারা নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে একটি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সমকাল : যে কোনো দাবি আদায়ে যে আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান প্রয়োজন হয়– দেশে কী সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?
মির্জা ফখরুল : আমরা দেখছি, মানুষের অংশগ্রহণ অনেক গুণ বাড়ছে। গণঅভ্যুত্থানের ভয় থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। আবার গোলাপবাগ ঠেলে দিতে চায়– এটাই তার প্রমাণ। গণবিস্ফোরণের আঁচ করতে পেরেছে সরকার। দেশে একটা গণঅভ্যুত্থান তৈরি হতে পারে। সেই ভয় থেকে এখন নানা আক্রমণাত্মক কাজ শুরু করেছে।
সমকাল : গণমাধ্যমে এসেছে, বাধাবিঘ্ন ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ সফল হলে সরকারকে সময় বেঁধে দিয়ে আল্টিমেটাম দেওয়া হতে পারে।
মির্জা ফখরুল : সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যেসব কর্মসূচি থাকে, সেগুলোই থাকবে। জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দেব। অতীতে আওয়ামী লীগের মতো আমরা হরতাল কর্মসূচি দিচ্ছি না। সে সময় এখনও আসেনি।
সমকাল : তাহলে কি সে সময় এলে হরতাল ও অবরোধ দেবেন?
মির্জা ফখরুল : আমরা এখন পর্যন্ত সেভাবে চিন্তা করিনি। আমরা চেষ্টা করব শান্তিপূর্ণ জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান তৈরি করে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে। সরকারের আচরণ, সময় ও পরিস্থিতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
সমকাল : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি আঘাত হানলে পাল্টা আঘাত করবেন।
মির্জা ফখরুল : তারা তো আঘাত করেই যাচ্ছে। আমরা কোনো আঘাত করিনি। এখন পর্যন্ত ৬০০ লোককে গুম করেছে। কয়েক হাজার লোককে হত্যা করেছে। ৪০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে গৃহবন্দি করে রেখেছে। আমরা আঘাত করলাম কোথায়?
সমকাল : আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে দাবি আদায়ের ব্যাপারে আপনারা কতটুকু আশাবাদী?
মির্জা ফখরুল : শতভাগ আশাবাদী। ইতোমধ্যে আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হয়ে গেছে। আন্দোলনের সঙ্গে দেশপ্রেমিক জনগণ সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নের এ আন্দোলনে দেশি-বিদেশিরাও নৈতিক সমর্থন দিচ্ছেন।
সমকাল : ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে লাগাতার আন্দোলন সফল হয়নি কেন?
মির্জা ফখরুল : আন্দোলনে এ রকম হতেই পারে। তবে এবার আমাদের জনসম্পৃক্ততা অনেক বেশি। মৌলিক মানবাধিকার আদায়ের এই আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সমর্থন আছে। জনগণের আন্দোলন কখনই ব্যর্থ হয়নি।
সমকাল : সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে অনড় বিএনপি; অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করতে অনড় আওয়ামী লীগ। এ সংকট উত্তরণের উপায় কী?
মির্জা ফখরুল : সংকট উত্তরণের পথ সরকারই বের করতে পারে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে তারা সারাজীবন ক্ষমতায় থাকতে সংবিধান সংশোধন করেছে। যেভাবে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে, এখনও সেভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করে তা বহাল করতে পারে। রাতের ভোটের মাধ্যমে বর্তমান সংসদে এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও তাদের রয়েছেই। ইচ্ছা করলেই এ সংকট উত্তরণ করতে পারে তারা। অন্যথায় ’৫২, ’৬৯, ’৭১ এবং ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতিতে স্বৈরশাসকদের মতো এ সরকারকেও বিদায় নিতে হবে।
সমকাল : বিদেশিদের ভূমিকায় বিএনপি চলমান আন্দোলনে গতি বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের। এটি কি সত্য?
মির্জা ফখরুল: মোটেও সঠিক নয়। বিএনপি দেশের জনগণের সমর্থন নিয়ে একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। ভোটাধিকার হারানো জনগণের অধিকার আদায়ে এবং তাদের সমর্থনেই এখন আন্দোলন করছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের কোনো ভূমিকা নেই। অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আওয়ামী লীগ নানা ফ্যাসিস্ট আচরণ শুরু করেছে। বিরোধী নেতাকর্মীকে দমনের পাশাপাশি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনকি মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বললে বিদেশিদের সমালোচনা করছে এবং কূটনীতিকদের তলব করছে।
সমকাল : প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে বিএনপি একটি বিবৃতি দিয়েছে। রাজনৈতিক মহলে এটি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল : সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা ভুল বার্তা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এতে বিভ্রান্ত না হয়ে রাষ্ট্রের আইন-কানুন মেনে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে তাদের আমলে নিয়োগকৃতদের চাকরি চলে যাবে ইত্যাদি ভুল বোঝানোর অপচেষ্টা করছে। আমরা তাদের বিরোধী দলের প্রতি অন্যায় না করে নিরপেক্ষভাবে ন্যায়ের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছি। এখানে হুমকি-ধমকি দেওয়ার কোনো বিষয় নেই।
সমকাল : নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন, এর কোনো রূপরেখা কি তৈরি করেছেন?
মির্জা ফখরুল : আমাদের সঙ্গে তারা কোনো জোটে নেই। তারা তাদের মতো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। আমরা আমাদের মতো সমমনাদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করছি।
সমকাল : হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় বিবৃতি দেওয়ায় ১৩ রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আপনার প্রতিক্রিয়া?
মির্জা ফখরুল : এ বিষয়ে বিবৃতি দেওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তারা চান নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। বাংলাদেশে গত ’১৪ ও ’১৮ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। ঢাকার একটি উপনির্বাচনে প্রার্থীকে যেভাবে আক্রমণ করেছে এবং অত্যাচার ও নির্যাতন করেছে– তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটাই এ সরকারের চরিত্র। এ ব্যাপারে তারা বিবৃতি দিতেই পারে। এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। তারা যেভাবে খুশি সেভাবেই নির্বাচন করবে, কেউ কথা বলতে পারবে না– তা তো হয় না।-সমকাল
এবিসিবি/এমআই