Type to search

Lead Story বাংলাদেশ রাজনীতি সম্পাদকীয় ও মতামত

আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন এবং হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

মতিউর রহমান চৌধুরী:

পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন কী করবেন? তার সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। ভারতে কতোদিন নির্বাসিত জীবন কাটাবেন? ১০০ দিন হয়ে গেছে দিল্লিতে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি তিনি। ঢাকায় তার বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যা মামলা। অন্য মামলা তো রয়েছেই। হত্যা মামলার আসামি হিসেবে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছে সরকার। তাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানো না হলেও প্রক্রিয়া চলছে। টাকা পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে চলেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগ এখন অস্তিত্ব সংকটে। বাতি জ্বালানোর মতো লোকজন নেই। কেউ সাহস করে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর কিংবা গণভবন দেখতেও যায়নি- সেখানে কী ঘটেছিল। হাসিনার সাড়ে পনের বছরের শাসনকে দুঃশাসন বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। দলের কোনো নেতাই এখন সাহস করে কথা বলছেন না। যদিও ইউনিয়ন পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মী হয় ভারতে কিংবা অন্য কোনো দেশে পালিয়ে গেছেন। এমন পরিস্থিতি এর আগে কখনো হয়নি। আওয়ামী লীগ এর আগেও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিল। ১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে সংকটে পড়ে দলটি। জাতীয় চারনেতা কারাগারে নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দিল্লিতে নির্বাসনে ছিলেন। বেগম জোহরা তাজউদ্দীন দলটির হাল ধরেছিলেন। মালেক উকিল, মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ বড় বড় নেতারা দলে নেই। অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব দলের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসন লাভ করে। পরের পরিস্থিতি সবার জানা। ১৯৮১ সনে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। এর আগে ইডেন গার্ডেনের সম্মেলনে তাকে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। দেশে ফিরেই তিনি দলটি নিজের কব্জায় নিয়ে যান। যারা তাকে নির্বাচিত করেছিলেন তাদের বেশির ভাগ সিনিয়র নেতাকেই দল ছাড়তে বাধ্য করেন। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, আবদুর রাজ্জাক অন্যতম। ড. কামাল হোসেন গঠন করেন গণফোরাম, আবদুর রাজ্জাক বাকশাল পুনর্গঠন করেন। যদিও কয়েক বছর পর ফিরে আসেন মূল দলে। হাসিনা ২১ বছর লড়াই করে ’৯৬ সনে দলটিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। প্রথম ৫ বছর ছিল অনেক গণতান্ত্রিক। চুরি-চামারি ছিল নিয়ন্ত্রিত। পরিবারের লোকজনকে রাখা হয়েছিল ক্ষমতার বাইরে। ২০০১ এর নির্বাচনে হেরে যাবার পর থেকে ভিন্ন কৌশল। ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বেছে নেন। পরিণতিতে আসে ওয়ান ইলেভেন। প্রথমে জেলে যান। কিছুদিন পর ওয়ান ইলেভেনের নায়করা হাসিনাকেই বেছে নেন। শুরুতে সেনা শাসকরা মাইনাস টু করার জন্য ছিলেন মরিয়া। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার পর মাইনাস টু থেকে তারা সরে যান। এখানে অবশ্য বেগম জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্ব জেনারেলদের ভাবিয়ে তুলেছিল। বেগম জিয়াকে বলপূর্বক বিদেশে পাঠানোর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর ২০০৮ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় আনার সিদ্ধান্ত নেন জেনারেলরা। তাদের সামনে তখন বিকল্প ছিল না। এরশাদের জমানায় শেখ হাসিনা কখনো বিপ্লবী, কখনো আপোষকামী। ’৮৬ সনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় বেঈমান হিসেবে বদনাম কুড়ান। তলে তলে এরশাদের সঙ্গে সমঝোতাও ছিল তার। ২০০৮-এর নির্বাচনে জেতার পর অন্য এক হাসিনাকে দেখতে পায় দেশের জনগণ। একক ক্ষমতা তার হাতে। ভারতের কথায় উঠেন আর বসেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ড যে তার জানামতে হয়েছিল এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে নানা তথ্য চাউর থাকলেও হাসিনা দায় এড়াতে পারবেন না কোনোদিন। ২০১৪ সন থেকেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা নেন। একের পর এক বিরোধী শক্তিকে দমন করতে থাকেন। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার সব কৌশলই গ্রহণ করেন। এক সাজানো মামলায় বেগম জিয়াকে কারাগারে নিয়ে যান। জনশ্রুতি রয়েছে সাজা দেয়ার আগে বেগম জিয়ার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন ২০১৮ এর নির্বাচনে  ১০০ আসন দেয়ার। একজন ব্যবসায়ী এই প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেগম জিয়া এক বাক্যে না করে দেন। এরপর থেকে তার প্রতিহিংসা দেখেছে জনগণ। নিজেকে স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সব কৌশলই গ্রহণ করেন। ভিন্নমত দমন করেন কঠোর ভাবে। হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে জেলে পাঠান। গুম আর খুনের মধ্যদিয়ে বিরোধী রাজনীতিও তার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেন। দেশের টাকা লুট করেন এবং লুটকারীদের দেখেও না দেখার ভাণ করেন। ফোকলা করে দেন দেশের অর্থনীতি। বলা হচ্ছে, এটা নাকি প্রতিহিংসার ফসল। বাংলাদেশের মানুষ পনের আগস্ট কেন রুখে দাঁড়ালো না- এই রাগ থেকেই দেশটিকে শ্মশানে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, নিজে লুটে যুক্ত হয়ে যাবার কারণে অন্যদের বিরত রাখতে পারেননি। ২ লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে হাসিনার শাসনকালে পাচার হয়েছে। তার পরিবারের লোকজন কতো টাকার মালিক- এটা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। প্রশাসনকে কব্জা করেছিলেন ভিন্ন কৌশলে। দুর্নীতির মধ্যে ডুবে গিয়েছিল প্রশাসন। এমনকি মিলিটারি প্রশাসনও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। যা ছিল নজিরবিহীন। যতদিন ইচ্ছে ততদিন ক্ষমতায় থাকার নেশায় ছিলেন বিভোর। বড়াই করে বলতেন ২০৪১ পর্যন্ত কে সরাবে তাকে। বিরোধী দল বিএনপি একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। দেশের মানুষের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম নেয় হাসিনাই থাকবেন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। সোজা পথে তাকে সরানো যাবে না। কোটা আন্দোলন এক অলৌকিক ইতিহাস রচনা করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। হাসিনা শতভাগ ভারতের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তার ধারণা ছিল ভারত তার নিজস্ব প্রয়োজনেই পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু সেটা দেখা যায়নি। বরং ভারত খেলেছে তার স্বার্থে। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল নিবিড়ভাবে।  ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী অতি সমপ্রতি বলেছেন, হাসিনার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে- এটা তারা টের পেয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা নিজে বুঝতে পারেন নি। প্রশ্ন উঠেছে ভারত কেন হাসিনাকে আগাম বার্তা দিলো না।   ৫ই আগস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাবার পর আওয়ামী লীগের গতি থেমে যায়। মনে হয় যেন জাদুকরের ফুঁ’তে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। তিন মাস পর প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগ কীভাবে পুনরুজ্জীবিত হবে। রাতারাতি তো আর আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। এখনো দলটির চাবি শেখ হাসিনার কাছে। তিনি কি দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন? পরিবারের কাউকে বেছে নেবেন? নাকি তিনি নিজেই অন্য শক্তির সাহায্যে আবার দৃশ্যপটে হাজির হবেন। এসবই গুঞ্জন। বাস্তবতা হচ্ছে এই মুহূর্তে একজন আমেনা বেগম, জোহরা তাজউদ্দীন কিংবা জিল্লুর রহমান নেই। দেশে যারা ছিলেন তারা হয় জেলে অথবা আত্মগোপনে। কেউ সাহস করছেন না। তাছাড়া হাসিনা কাউকে বিশ্বাস করতেও পারছেন না। দলের একজন  প্রেসিডিয়াম সদস্যও দেশে নেই। ওবায়দুল কাদের অনেকদিন দেশে ছিলেন। এক রহস্যজনক সমঝোতায় এক সপ্তাহ আগে ভারতে চলে গেছেন- এমনটাই বলাবলি আছে। দলের ভেতরেই ওবায়দুল কাদের সমালোচিত। ৩১শে জুলাই বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের এক বৈঠকে কাদেরকে মারতে গিয়েছিলেন কয়েকজন নেতা। তাদের কথা, কাদেরের ভুল রাজনীতির কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট- এমন মন্তব্যে পরিস্থিতি আরও জটিল ও ঘোলাটে হয়ে যায়। এক পর্যায়ে মুখপাত্রের ভূমিকা থেকে ওবায়দুল কাদেরকে সরিয়ে দেন শেখ হাসিনা। জাহাঙ্গীর কবির নানক তিন/চারদিন দায়িত্ব পালন করেন। নূর হোসেন দিবসে দলকে সংগঠিত করার প্রাথমিক চেষ্টা বিফলে যায়। পরের কৌশল কী? ভারতের ওপর নির্ভর করে কতোদিন বসে থাকবেন। ঢাকায় তাকে ফিরিয়ে আনার চাপ বাড়ছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় ভিন্ন পরিস্থিতি। নতুন করে অঙ্ক মেলাচ্ছেন অনেকে। কিছুটা সুবিধা পেতে পারে দলটি- এমনটাই বলছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে এটা নির্ভর করে বর্তমান ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ওপর। তারা যদি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হতে থাকেন, নির্বাচন বিলম্বিত করেন তাহলে অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে দেশ। যা আমরা কেউই কামনা করি না। যাই হোক আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের কাজটি যে অনেক দূরেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগেও আওয়ামী লীগ সংকটে পড়েছে। কিন্তু এবারের মতো নয়।

মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক

মানবজমিন

Translate »