অন্য দেশের দিকে তাকাচ্ছে ভারত

গত সপ্তাহে একই সঙ্গে তিনটি ঘটনা ঘটল। চীন বাদে বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক চালুর সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত রাখা হলো। ভারতে রিজার্ভব্যাংকের গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা রেপো রেট ২৫ বেসিক পয়েন্ট কম করে বলেছেন, বিশ্ব জুড়ে যে পরিস্থিতি, তাতে আর্থিক বৃদ্ধির বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে গেল। তিন নম্বর বিষয়টা হলো, যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিল, তারা এবার ওষুধের ওপরও শুল্ক বসাবে। গতবার ওষুধ ও সেমিকন্ডাক্টরে শুল্ক বসানো হয়নি।
এই তিনটি ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভারতের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রভাব কতখানি পড়তে চলেছে। চীন যেখানে সরাসরি ট্রাম্পের বসানো শুল্কের পালটা হিসেবে মার্কিন পণ্যে শুল্ক বসিয়েছে, ভারত সেখানে কোনোরকম সংঘাতের পথে যায়নি। বরং বাজেটে কিছু পণ্যে শুল্ক কমিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের এখনো আলোচনা চলছে। কিছু দিন আগে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আলোচনা করেছেন। এখন কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা চলছে। এক কথায় ভারত নরম নীতি নিয়ে আলোচনা করে, শুল্ক কমিয়ে পরিস্থিতি সামলাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই কাজ কতদূর এগিয়েছে, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
যতদিন আলোচনায় কোনো ফল না হচ্ছে, ততদিন এই শুল্কের খাঁড়া মাথার ওপরে থাকবে। আর ট্রাম্প-সহ অন্যরা বারবার করে একটা কথা বলছেন, কৃষিক্ষেত্রকে মার্কিন কৃষিপণ্যের জন্য খুলে দিতে হবে, অর্থাৎ সেখানে শুল্ক কমিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এখানে ভারতের ব্যাপক অসুবিধা। ভারত এখনো মূলত কৃষিনির্ভর দেশ। ভারতের কৃষিতে প্রভাব ফেলবে এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে সেই বার্তাটা একেবারেই ভালো যাবে না। কৃষকদের আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে এর আগে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। ফলে তিনি জানেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিজ পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কম করে দিলে কৃষকরা ব্যাপক চটবেন, আন্দোলন করবেন। তার রাজনৈতিক ধাক্কা তাকে সামলাতে হবে। তাই ভারত এই দাবি মানতে চাইছে না।
ভারতের চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ওষুধের ওপর শুল্ক বসানোর বিষয়টি। ২০২৪ সালে ভারত ২ হাজার ৭৯০ কোটি ডলারের ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করেছে। তার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ৮৭০ কোটি ডলারের ওষুধ। যুক্তরাষ্ট্র যদি ওষুধের ওপর শুল্ক বসায়, তাহলে এই ওষুধ কোম্পানিগুলো মার খেতে বাধ্য। তাতে তাদের শুধু আয় কমবে, তা নয়। তারা কর্মী সংকোচন করবে। তার সামগ্রিক প্রভাব সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পড়বে।
যেমন ট্রাম্প শুল্ক চালু করলে ধাক্কা পড়তে পারে ডায়মন্ড শিল্পের ওপর। ভারতের ডায়মন্ড শিল্পের এক তৃতীয়াংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। মাসুল বাড়ার ফলে সেখানেও ধাক্কা লাগতে পারে। ওষুধের মতোই ভারতের দামি পাথর ও অলঙ্কার শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির ওপর খুব বেশি করে নির্ভরশীল। এছাড়া ভারতীয় গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ট্রাম্পের শুল্কের ধাক্কা সেখানেও ভালোভাবে পড়বে।
কোনো সন্দেহ নেই, ভারতের সুবিধা হলো, দেশের ভিতরে তার খুব বড় বাজার আছে। কিন্তু বিদেশি বাজার, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো লাভজনক বাজারে ধাক্কা খেলে তার বিশাল প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য। এ কথা ঠিক, অসুবিধাটা শুধু যে ভারতের হবে তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও হবে। সেখানেও জিনিসের দাম বাড়বে।
ট্রাম্প পরে কী করবেন, তা নিয়ে জল্পনা করে লাভ নেই বরং। যে ধাক্কাটা তিনি দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তিন মাস পর আবার যে ধাক্কাটা আসতে পারে, সেটা কী করে কাটবে সেই আলোচনাই বেশি জরুরি।
তাহলে ভারত ধাক্কাটা সামলাবে কী করে? আর এখানেই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বিশ্বের দিকে তাকাচ্ছে ভারত। সম্প্রতি ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যুক্তরাজ্য সফরে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বলেছেন, ভারত ও যুক্তরাজ্য তাড়াতাড়ি হোক বা কিছু দিন পরে হোক, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সেরে ফেলবে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কথা চলছে। নির্মলা বলেন, আমার মনে হয়, গোটা বিশ্ব এই পথেই চলেছে।
ভারতের অর্থমন্ত্রী আরেকটা কথা বলেছেন। সেটা হলো, প্রত্যেক দেশ চাইছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক-আঘাতের হাত থেকে বাঁচতে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে। সেখানে আগেকার দিনের মতো বন্ধু-শত্রু ভেদটাও ঘুচে যাচ্ছে। অর্থাৎ, নিজেদের স্বার্থরক্ষা করে অন্য দেশের স্বার্থটাও রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়েছে তারা। চীনও যেমন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের ধাক্কা সামলাতে ইইউ-সহ অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, ট্রাম্প যদি তিন মাস পরেও শুল্ক চালু করেন বা ভারতকে শুল্ক কমাতে বাধ্য করেন, তাহলেও ভারতের ধাক্কা লাগবে। তবে নদীর পানি যেমন বাধা পেলে তার পথ খুঁজে নেয়, সেরকমভাবেই ভারত সেই বাধা পার হয়ে বেরোবার চেষ্টাও করছে এবং করবে।
সূত্র: ডয়চেভেলে