মাঙ্কিপক্সের নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি

মাঙ্কিপক্স নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। রোগের প্রাদুর্ভাবকে বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই সতর্কতার মানে কী? কারা এটি নির্ধারণ করে এবং এর পরে কী হতে পারে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাধনম ঘেব্রেয়েসুস শনিবার মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কমিটির সদস্যরা অবশ্য সবাই এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হননি। জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো কর্তাব্যক্তি এই প্রথম এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিলেন।
কী বলেছেন টেড্রোস?
টেড্রোস বলেন, ‘‘আমরা একটি প্রাদুর্ভাব দেখছি, যেটির সংক্রমণে নতুন মোড় নিয়ে দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি এবং এটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধিমালার মানদণ্ড পূরণ করে। আমি জানি এটি একটি সহজ বা সরল প্রক্রিয়া ছিল না এবং কমিটির সদস্যদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।”
তিনি বলেন, ‘‘আমি আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছি।তবে এই মুহূর্তে এটি এমন একটি প্রাদুর্ভাব যা কেবল পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যৌন সম্পর্কে কেন্দ্রীভূত। বিশেষ করে যারা একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত।এর মানে হল যে এটি এমন একটি প্রাদুর্ভাব যা সঠিক কৌশল দিয়ে থামানো যেতে পারে।”
প্রাদুর্ভাব যেভাবে ছড়িয়েছে
চলমান প্রাদুর্ভাব শুরু হয় মে মাসে। ব্রিটেনে ২০ মে ২০ জনের শরীরে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়।এদের বেশিরভাগই ছিলেন সমকামী পুরুষ।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ৭৫টি দেশে ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষের দেহে এই রোগের জীবাণু পাওয়া গিয়েছে। টেড্রোস জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির তথ্য অনুযায়ী এক দিনেই দেশটিতে এর প্রাদুর্ভাব এক হাজারেরও বেশি মানুষের শরীরে ছড়িয়েছে। ১৯ জুলাই ১৪ হাজার ৫১১ জন থেকে ২০ জুলাই এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৩৭৮ জনে। তবে এখনই প্রাদুর্ভাবটি মূলত ইউরোপেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে।
১৪ জুলাইয়ের পর থেকে থাইল্যান্ড, সার্বিয়া, জর্জিয়া, ভারত, সৌদি আরবসহ নানা দেশ তাদের প্রথম মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্তের তথ্য জানায়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে কি না, এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে মহামারি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।২৩ জুলাই একটি সভায় তাদের অনেকেই মাঙ্কিপক্সকে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণায় বিষয়ে একমত হননি। পরবর্তীতে আবার আলোচনার জন্য বৈঠক আহ্বান করা হয়।
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন এর আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক জিমি হুইটোয়ার্থ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘কমিটির জন্য এটা একটা জটিল সিদ্ধান্ত ছিল। একদিকে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যেভাবে এটি এতগুলো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পেলে নিয়ন্ত্রণে আনতে সুবিধা হবে।”
তিনি বলেন, ‘‘তবে অন্যদিকে, এটা এমন এক সংক্রমণ যা নিয়ন্ত্রণের উপায় আমাদের কাছে রয়েছে। বেশিরভাগ সংক্রমণই মৃদু এবং মৃত্যুর হারও খুব কম।”
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা কী?
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বোচ্চ সতর্কতা। ২০০৫ সালের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধির ওপর ভিত্তি করে আন্তঃসীমান্ত জনস্বাস্থ্য উদ্বেগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয় এর মাধ্যমে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কমিটিতে ১৬ জন সদস্য রয়েছেন। এর চেয়ারম্যান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর জ্যঁ-মারি ওকুও-বেলে।এর আগে সংস্থার টিকা ও টিকাদান কর্মসূচির প্রধান ছিলেন তিনি। কমিটির বাকি সদস্যরাও বিভিন্ন দেশের মহামারি এবং নানা রোগের বিশেষজ্ঞ।
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো একটি প্রাদুর্ভাব ব্যাপক আকারে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলে আগে থেকেই সে বিষয়ে সতর্ক করা। এর ফলে নানা দেশের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সহজ হয় এবং দ্রুত নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা যায়।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর ফলে বাণিজ্য ও ভ্রমণ বন্ধ হয়ে গেলে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমন আশঙ্কায় অনেক দেশই নিজেদের সীমান্তের মধ্যে প্রাদুর্ভাবের সঠিক তথ্য জানাতে গড়িমসিও করে।
এখনো পর্যন্ত ছয় বার
আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এখনো পর্যন্ত ছয় বার ঘোষণা করা হয়েছে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনের বাইরে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তহওয়ার পর এটিকে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে দ্রুতই এটি বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ইবোলা নিয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
এবার এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল পূর্ব ডিআরসিতে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি হয়। ব্রাজিলসহ প্রায় পুরো ল্যাটিন অ্যামেরিকা মহাদেশেই এর সংক্রমণ ঘটেছিল।
২০১৪ সালের আগস্টে ইবোলার জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ছাড়াও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়েছিল এই ভাইরাস।
২০১৪ সালের মে মাসে পোলিওর সংক্রমণ নিয়ে আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং নাইজেরিয়ায় টিকা না পৌঁছানো কিছু অঞ্চলে ‘ওয়াইল্ড পোলিও’ ছড়িয়ে পড়ে।করোনার পাশাপাশি এই রোগের আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা এখনও জারি রয়েছে।
২০০৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল এইচ ওয়ান এন ওয়ান বা সোয়াইন ফ্লু এর জন্য। মেক্সিকো থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ।
এরপর কী?
মাঙ্কিপক্সের টিকা আগেই আবিষ্কার হয়েছে এবং তা সংক্রমণ ঠেকাতে বেশ কার্যকরও। কিন্তু দ্রুত এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বজুড়ে বিপুল সংখ্যায় টিকা উৎপাদন, সরবরাহ ও টিকাদান নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়ে পারে।
টেড্রোস জানিয়েছেন, মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ঠেকাতে নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য কাজে লাগাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কেউ কেউ অবশ্য এখনো পর্যন্ত পাওয়া সংখ্যা ও তথ্যের ভিত্তিতে এই রোগের মহামারিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন।
তবে এমন সম্ভাবনা বিষয়ে দ্বিমতও রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক হুইটওয়ার্থ বলেন, ‘‘এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সাধারণ মানুষের মধ্যে এটা বেশি ছড়ানোর আশঙ্কা খুব কম। ফলে আমি মনে করি না, এটা মহামারিতে পরিণত হবে।”
এবিসিবি/এমআই