Type to search

Lead Story আন্তর্জাতিক

ওমিক্রনে বিপর্যস্ত আমেরিকা ইউরোপ

কোভিড-১৯ নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সারা বিশ্বে আবারও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। মঙ্গলবার এক দিনেই বিশ্বে ১২ লাখ ৩১ হাজার ৫৮৯ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এক দিনেই আক্রান্ত ৪ লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ। গত এক সপ্তাহে দেশটিতে গড়ে প্রতিদিন আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার জন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, ইউরোপের অনেক দেশেই করোনা সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

যুক্তরাজ্যে মঙ্গলবার আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার আর ফ্রান্সে প্রায় ২ লাখ ৮ হাজার মানুষ। সংক্রমণ বাড়ছে স্পেন, ইতালি, গ্রিস ও পর্তুগালে। এর মধ্যে পোল্যান্ডে এক দিনেই ৭৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। অন্যদিকে গতকাল ভারতে আগের দিনের চেয়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। ভারতে ওমিক্রন সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের দাপটের মধ্যে বাংলাদেশেও দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ফের ৫০০-র কাছাকাছি পৌঁছেছে। গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯৫ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এক দিনে শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে আবার বিপর্যয় আসতে সময় লাগবে না বলে সতর্ক করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওমিক্রন যাতে দেশে দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। যে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, আকস্মিক সংক্রমণ বাড়ার কারণ করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণের সংখ্যা ইতিমধ্যে অনেক দেশে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণের হার বেশি। ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওলিভার ভেরান বলেছেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ প্রতি দুই থেকে তিন দিনে দ্বিগুণ হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতি সেকেন্ডে ফ্রান্সে দুই জনের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ২২ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ডিসেম্বর বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ৯ লাখ ৩৫ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এই সংখ্যা করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালিতে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের জেরে সংক্রমণ বেড়েছে অস্ট্রেলিয়াতেও।

ওমিক্রনে বিপর্যস্ত প্রথম পৃষ্ঠার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও সংক্রমণ বেড়েছে। মঙ্গলবার দেশটিতে দুই হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, যা গত জুনের পর সর্বোচ্চ। আফ্রিকার দেশ কেনিয়াতেও সংক্রমণ বাড়ছে। এ অবস্থায় নাগরিকদের করোনা টিকার বুস্টার ডোজ নেওয়ার জন্য নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সংক্রমণ ঠেকাতে নেদারল্যান্ডসে লকডাউন বলবত রয়েছে। ফ্রান্সে নাইট ক্লাব বন্ধের সময়সীমা আরো তিন সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। সংক্রমণ এড়াতে বিভিন্ন দেশের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের মুখে প্রতিদিনই বিশ্বে বাতিল হচ্ছে হাজার হাজার ফ্লাইট। বাড়ছে যাত্রীদের দুর্ভোগও।

সিএনএনের এক খবরে বলা হয়েছে, গতকাল বুধবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে বড়দিনের সময় ভ্রমণে বিধিনিষেধ দেওয়ায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। জার্মানির বিমান সংস্থা লুফথানসা জানিয়েছে, বুকিং কমে যাওয়ায় তারা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৩৩ হাজার ফ্লাইট বাতিল করবে।

ভারতে নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা
ভারতের মঙ্গলবার এক দিনে নতুন করে ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ১৯৫ জন, যা আগের দিনের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে দেশটিতে এখন পর্যন্ত ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়েছেন প্রায় ৮০০ জন। করোনার এই নতুন ধরনে দেশটিতে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আসার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দিল্লিতে এখন পর্যন্ত ২৩৮ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখন পর্যন্ত ১১ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সংক্রমণ বাড়তে থাকলে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়াসহ লোকাল ট্রেনের সংখ্যা কমানো হতে পারে।

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা যা বললেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন যেহেতু পার্শ্ববর্তী দেশে আছে, তাই বাংলাদেশে ঝুঁকি থাকাটা স্বাভাবিক। ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। ওমিক্রন দ্রুত চরিত্র বদলায়। তাই সময় থাকতে সবার সতর্ক হতে হবে। সভা-সমাবেশসহ যে কোনো ধরনের জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। বিমান, নৌপথসহ সীমান্ত কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। আক্রান্তদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে।

কোভিড-১৯-সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও সংক্রমণ বাড়ছে। তাই চরম ঝুঁকিতে আছি আমরা। তবে করোনা ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টসহ যে ভ্যারিয়েন্টই আসুক না কেন, মাস্ক পরলেই নিরাপদে থাকা যাবে। একই সঙ্গে করোনার টিকা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস অনেক সময় টিকাকে ফাঁকি দিতে পারে, কিন্তু মাস্ককে ফাঁকি দিতে পারে না। তাই সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, করোনা সংক্রমণ বাড়লে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় ১০ বেডের আইসিইউ স্থাপন করার কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে। আগে যেসব হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড ঘোষণা করে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছিল, রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেসব হাসপাতালে আবারও করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন জেনারেটর বসানো হয়েছে। অক্সিজেনের কোনো সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধে মাস্ক পরতে হবে, টিকা নিতে হবে। দেশে প্রায় ৫ কোটি টিকা মজুত রয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে করোনার টিকা দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, বর্তমানে বিশ্বের সব দেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ বাড়ছে। বাংলাদেশেও বাড়ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটা ধরে রাখতে হলে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে।

এবিসিবি/এমআই

Translate »