আফগানিস্তানের বুকে থাকা মহামূল্য সম্পদ পাবে কে

ডেস্ক : বিশ্বের চোখ এখন আফগানিস্তানের ভূগর্ভস্থ বিপুল সম্পদের দিকে। সোনা, তামার পাশাপাশি দেশটিতে রয়েছে মূল্যবান লিথিয়াম ও বিরল ধাতু। এসবের মূল্য ৩ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি বলে অনুমান করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবানের আফগানিস্তানে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘ ২০ বছরের অভিযান থেকে সরে আসার পর তালেবানরা নিজেদের হাত-পা পুরোপুরি মেলে দিয়েছে; কিন্তু অঢেল এই প্রাকৃতিক সম্পদ, মানবসম্পদ আর ভৌগোলিক অবস্থানকে তারা কাজে লাগাতে পারবে কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের দাবি, আফগানিস্তানের পাহাড় ও উপত্যকায় মূল্যবান খনিজ পদার্থ যেমন তামা, লোহা, বক্সাইটের পাশাপাশি সোনা, হীরা ও পান্নার মতো দামি পাথরও রয়েছে। যদিও আফগানিস্তান এখনও সেগুলো তুলে বিক্রি করতে পারেনি। কিন্তু এ আয় মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে।
ভারত, ব্রিটেন, কানাডা এবং চীনের বিনিয়োগকারীরা দেশটির সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু কেউ এখনও কাজ শুরু করেনি। বাণিজ্যের উপযোগী দেশের তালিকায় আফগানিস্তানকে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৩তম স্থানে রেখেছে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আফগানিস্তান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম স্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় দেশটির খনিজ সম্পদ আহরণে সাতবার ভাবতে হচ্ছে চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে।
নকশা আছে, খনন নেই
ষাটের দশকে সোভিয়েত ভূতত্ত্ববিদরা আফগানিস্তানের ভূগর্ভস্থ সম্পদ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং খনি খননের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী অর্ধশতাব্দীতে আফগানরা ধারাবাহিক যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল। কখনও সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে, কখনও বা গৃহযুদ্ধে। আর তারপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের সঙ্গে দুই দশকের যুদ্ধ।
সাধারণভাবেই ভূতত্ত্ববিদদের সেইসব নকশা ও ফাইলে ধুলো জমে যায়। কখনও শুরু হয়নি খনির কাজ। তৈরি হয়নি কোনো কারখানাও। খনিজ সম্পদ বের করতে না পারায় অনেক পাহাড়কে লাল ও সবুজ রঙ দিয়ে চিহ্নিত করা হয় তখন। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই কিছু খনন কাজ করেছে তালেবানরা। সেগুলো শুধুমাত্র পান্না, নীলা আর হীরা পেতে। আর এই খননকাজ আফগান সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়। তালেবানরা এই মূল্যবান পাথর সাধারণত পাকিস্তানে পাচার করে থাকে।
আফিমভিত্তিক অর্থনীতি
দীর্ঘ সময় ধরে আফগানিস্তানের অর্থনীতির ভিত্তি হয়ে আছে আফিম। জাতিসংঘের অনুমান- আফগানিস্তানের পুরো অর্থনীতির প্রায় ১০ শতাংশের জোগান আসে আফিম থেকে। আফিম রফতানি দেশটিতে অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি। ফলে সম্পদসমৃদ্ধ দেশটি বিশ্ববাজারে লিথিয়াম সরবরাহে ভূমিকা রাখছে না। বরং বিশ্বের ৮৫ শতাংশ কাঁচা আফিম ও হেরোইন সরবরাহ করছে।
যুক্তরাষ্ট্র গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে খনি শিল্পের বিকাশে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছিল। তারা আর্কাইভ ঘেঁটে সোভিয়েত গবেষকদের নকশা বের করে এবং সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে নিজেরা নতুন নকশা তৈরি করে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) ৪০ টেরাবাইট তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং খনিজ সম্পদের সুরক্ষায় আফগানদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আফগানিস্তানকে হাইপারস্পেক্ট্রাল ইমেজিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ১০০ শতাংশ পরীক্ষা করা হয়েছে। ফলে আমেরিকানরা ৬০টি অত্যাধুনিক নকশা প্রকাশ করে। কিন্তু এই নকশাগুলো শুধু সম্পদ অনুমান করতে ব্যবহার করা যেতে পারে, বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য নয়।
আফগানিস্তানে আনুমানিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের লিথিয়াম এবং অন্যান্য বিরল ধাতুর মজুদ রয়েছে। কিন্তু তাদের খনি খননের জন্য যে অর্থ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো প্রয়োজন, তা নেই।
ভারত ও চীনের আগ্রহ প্রকাশ
মার্কিন উপস্থিতির সময় আফগানিস্তানে অর্থ আসতে শুরু করে। আফগানিস্তান বিশ্বের অনেক ধনী দেশ থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, কৃষি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে। বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সমতার উন্নয়নে পাঁচ বিলিয়ন ডলার দিয়েছিল। আফগান কর্মকর্তারা খনি খাতের উন্নয়নে বিদেশ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীও এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল তখন। তারা সবাই ছিল দেশটির শক্তিশালী প্রতিবেশী। চীন এবং ভারত অর্থনৈতিক কারণের চেয়ে রাজনৈতিক কারণে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারত ১১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দেশটি তিন বিলিয়ন ডলার খরচও করেছে। কিন্তু এখন ভারত ফিরে যাচ্ছে।
স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে আফগানিস্তানে একাধিক ভারতীয় কোম্পানির একটি ধাতুবিদ্যা কেন্দ্র স্থাপন করার কথা ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ছিল লোহার মান ও নিরাপত্তা নিয়ে। এখন সরকার পরিবর্তিত হয়েছে এবং তালেবানদের সঙ্গে একটি চুক্তির ক্ষীণ আশাও ঝুলছে। তবে চীন ও তালেবানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এই আশাকে দুরাশার দিকে ঠেলে দিতে পারে। অন্যদিকে চীনা কোম্পানিগুলো এখনই বিনিয়োগ করতে চাইছে না। তারা গৃহযুদ্ধের শঙ্কা কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
২০০৮ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি কোম্পানিকে কাবুলের কাছে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় তামার খনি খননের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সে সময় আনুমানিক ১১ টন লিথিয়াম পাওয়া যায় ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় থাকা একটি বৌদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভের নিচে। কিন্তু এক যুগ পরও সেটি খনন করা হয়নি এবং মূল্যবান লিথিয়ামের বড় এই মজুদ রয়ে গেছে মাটির নিচেই।
২০১৬ সালে তালেবান ঘোষণা করেছিল যে তারা সব খনির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। এই ঘোষণার ফলে কাবুলে মার্কিন কর্মকর্তারা ব্যাপক সমালোচিত হন। এ ছাড়া বছর দুই আগে তালেবানরা একটি খননকেন্দ্রে হামলা করে আট আফগান শ্রমিককে হত্যা করে। এই শ্রমিকরা চীনের জন্য কাজ করছিল।
চীন কি আবার কাজ শুরু করবে?
চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস এক শীর্ষ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ার পর দেশটিতে সব চীনা প্রকল্প স্থগিত রয়েছে। রয়টার্স জানায়, চীনের তেল কোম্পানি সিএনপিসি আফগানিস্তানের আমুদরিয়া অববাহিকায় তেল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না মেটালার্জিক্যাল গ্রুপ আয়ানক কপার ডিপোজিট জিয়ানক্সি কপার কোম্পানির সঙ্গে কাজ শুরু করার কথা ভাবছে। তবে তারা তখনই কাজ শুরু করবে, যখন আফগানিস্তানের পরিবেশ স্বাভাবিক হবে এবং তালেবান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবে। আফগানিস্তানের বহু মূল্যবান ‘গুপ্তধনে’র ব্যাপারে চীন আশা ছাড়েনি এবং তারা তাড়াহুড়া করছে না।
টিএস