একতরফা’ নির্বাচন প্রতিহত করতে আন্দোলনকে আরও জোরদার করার পরিকল্পনা বিএনপির

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় ছাড়া রাজপথ ছাড়বে না বিএনপি। ‘একতরফা’ নির্বাচন প্রতিহত করতে সারাদেশে আন্দোলনকে আরও জোরদার করার পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। বিশেষ করে চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিকে আরও কঠোর করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। একই সঙ্গে তাদের আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে নানামুখী কৌশলও নেওয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, গণগ্রেপ্তার, হয়রানি আর দ্রব্যমূল্যের ইস্যু কাজে লাগাতে চাইছেন দলের হাইকমান্ড। রাজপথের আন্দোলন-বিরতির মধ্যে মাঠে নামানো হবে বিভিন্ন পেশাজীবী, নারী সংগঠনসহ গুম-খুন ও কারা নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের। একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা ও নির্বাচনের বাইরে থাকা বাম-ডান ও ইসলামী দলগুলো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল।
দলীয় সূত্র জানায়, টানা রাজপথের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ভিন্নতা আনবে দলটি। দীর্ঘদিন একই কর্মসূচিতে নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি হতে পারে। এতে তাদের পুরো আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ চিন্তা থেকে আন্দোলনের নতুন কৌশল নিয়ে ভাবছেন দলের হাইকমান্ড। সম্প্রতি দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন নেতারা। বৈঠকে একজন নেতা বিষয়টি উত্থাপন করে বলেন, আন্দোলনের একঘেয়েমি দূর করতে নতুনত্ব আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে আন্দোলনের বিরতির মধ্যে নতুন ধরনের কিছু কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। এর মধ্যে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচির প্রস্তাবও তুলে ধরেন তিনি।
সূত্র জানায়, এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও ওই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন অন্যরা। তাদের মতে, সভা-সমাবেশ করার মতো অনুকূল পরিবেশ এখন আর নেই। সারাদেশে নেতাকর্মী আন্দোলনমুখী। প্রত্যেকে ঘরছাড়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে তাদের অনেকে বনে-জঙ্গলে, ধানক্ষেতে রাত যাপন করছেন। সবার বিরুদ্ধেই মামলা। এ অবস্থায় তাদের আবারও সভা-সমাবেশে ফিরিয়ে আনলে গ্রেপ্তার হতে পারেন; হামলার শিকার হতে পারেন। তাই দলের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ না করে বিভিন্ন পেশাজীবী, নারী সংগঠন ছাড়াও গত এক মাসে সারাদেশে গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মীর পরিবারকে মাঠে নামানোর চিন্তা করছেন তারা।
দলটির নেতারা জানান, ওই পরিকল্পনার ‘এসিড টেস্ট’ হিসেবে সম্প্রতি পেশাজীবীর ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ রকম একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে কাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গুম, খুন, হামলা-নির্যাতনে পঙ্গুত্ববরণকারী, গায়েবি মামলায় কারা নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীর পরিবারের স্বজনদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত ওই সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির সব ওয়ার্ডের গুম-খুনের শিকার এবং কারাগারে আটক নেতাকর্মীর মা, বোন, স্ত্রী, ভাইবোন ও কন্যাকে থাকার জন্য বলা হয়েছে। এসব কর্মসূচির লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নেতাকর্মী বাসায় থাকতে পারে না। অধিকাংশ নেতাকর্মী জেলে। বাকি যারা আছে, তারা নিজ বাসায় থাকতে পারে না; কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকতে হয় বা পরিচিত মানুষের বাসায় থাকতে হয়। গ্রামগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মী নিজ বাসায় থাকতে পারে না, আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকতে পারে না। এক বীভৎস পৈশাচিক অভিযান চলছে সারাদেশে। তবে এ অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। অচিরেই দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করবে। জনগণের বিজয় এবার হবেই।
বিরোধী দলের একাধিক নেতা জানান, সরকার পতনে তাদের চলমান আন্দোলনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কর্মপরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। তবে এর সবকিছুই রয়েছে প্রাথমিক স্তরে। আগামীতে কী হবে, কী করা হবে না– সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত বিভিন্ন অংশীজনের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। সেখানে কারা নির্যাতিত নেতাকর্মীর পরিবারের সদস্যদের দিয়ে পৃথক কর্মসূচির আয়োজনের বিষয়কে সবাই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
বিএনপির দাবি, গত দেড় মাসে দলের ৫৮২ নেতাকর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১৫ মামলায় আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৭০৫ জনকে; গ্রেপ্তার ৪১০, আহত ৬০। গত ১৫ নভেম্বর তপশিল ঘোষণার পর থেকে সারাদেশে ১৫৩ মামলায় আসামি ১৭ হাজার ৮৩০, গ্রেপ্তার ৪ হাজার ৬১০, আহত ৬৩২ এবং নিহত হয়েছেন ৪ জন। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ৪২২ মামলায় গ্রেপ্তার ১৬ হাজার ৬২৫, আহত ৪ হাজার ৬৮৮ এবং নিহত ১৭ জন।
বিএনপি নেতারা জানান, এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় আসামি করে প্রত্যেককে ঘরছাড়া করা হয়েছে। তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক জীবন এখন তছনছ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাদের রাজপথেই ফয়সালা করতে হবে। বিকল্প চিন্তা হিসেবে নেতাকর্মীকে আন্দোলনের মাঠে রেখে তাদের পরিবারের সদস্যদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়– সেটাই চিন্তা করছেন দলের সিনিয়র নেতারা। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের বাঁচার আকুতি, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থা আর তাদের ওপর করা জুলুম-অন্যায় বিচার কীভাবে প্রভাব বিস্তার করছে– তা তুলে ধরা হবে। এসবের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের পাতানো একতরফা নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দিতে বিরত রাখার কৌশলও নেওয়া হবে।
কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, ৩০ নভেম্বরের পর তাদের চলমান আন্দোলনকে কীভাবে আরও চাঙ্গা করা যায়, কঠোর করা যায়– সেসব নিয়েও নেতাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। প্রতিটি জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। গত এক মাসে যেসব নেতাকর্মী, সাংগঠনিক ইউনিট গা-ঢাকা, আত্মগোপনে ছিলেন– তাদের আবারও মাঠে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। তবে যেসব ইউনিট সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বলে মনে করা হচ্ছে, সেসব ইউনিটকে সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি ছাড়াও দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কমিটিতে এখন থেকেই মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এর মধ্যে গত শনিবার স্বেচ্ছাসেবক দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নরসিংদী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার শামস কেনেডি আন্দোলন কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে বরিশাল স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম জনি, চাঁদপুর জেলা সদস্য সচিব কাজী মো. ইবরাহিম জুয়েল ছাড়াও ঝালকাঠি জেলা কমিটিকেই বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েকটি জেলা কমিটির নেতার দায়িত্বে অবহেলা, নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে পুরো কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন জেলায় ছাত্রদল, যুবদল ছাড়াও অন্যান্য সংগঠনের নিষ্ক্রিয় নেতাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান বলেন, সবার আগে দেশ। এখন দেশের গণতন্ত্র আর ভোটাধিকারের জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে আছেন তারা। সেখানে কারও ন্যূনতম গাফিলতি দেশের ক্ষতি বয়ে আনবে, জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে যারাই নিষ্ক্রিয় থাকবেন, তাদেরই জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, অচিরেই তাদের সব প্রতিকূলতা কেটে যাবে। সরকার নানামুখী চাপে তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে। একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে এবার শুধু সমালোচনা নয়, তারা তোপের মুখেও পড়বে বলে বিশ্বাস দলটির। এ অবস্থায় যে কোনো উপায়ে মাঠের কর্মসূচি আরও বেগবান করতে চাইছেন বিএনপি নেতারা। সে ক্ষেত্রে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে মাঠের আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন দলের শীর্ষ নেতারা। আর সেটাকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত টেনেও নেওয়া হবে। নির্বাচনের অন্তত এক সপ্তাহ আগে ‘অলআউট’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সমমনা সব দল ও জোট ছাড়াও একই আন্দোলনে থাকা জামায়াতসহ অন্যদের জোটবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবেন।
এখনই খুলছে না নয়াপল্টন কার্যালয়
নেতাকর্মীর জন্য নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে না আসা পর্যন্ত দলের প্রধান কার্যালয় ঘিরে কোনো পরিকল্পনা নেই দলটির। প্রায় এক মাস তালাবদ্ধ আছে নয়াপল্টনের এ কার্যালয়। নির্বাচনের আগে ওই তালা খোলার কোনো সিদ্ধান্তও নেই। দলটির নেতারা মনে করছেন, কার্যালয় ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে তৎপরতা, তাতে নেতাকর্মীর কেউ নিরাপদ নয়। গেলেই আটক হতে হচ্ছে। তাই নির্বাচনের আগে ওই কার্যালয় খোলার কোনো পরিকল্পনাও নেই তাদের।
দলের দপ্তরের একজন নেতা জানান, এটাকে নির্বাচনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার টার্গেটও আছে দলটির। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচন, অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় দলটির কার্যালয়ে ঝুলছে তালা। এটা দিয়েই প্রমাণ হবে– দেশে কী রকম নির্বাচন হচ্ছে।-সমকাল
এবিসিবি/এমআই