আদালতপাড়ায় কমছে না বিএনপি নেতাকর্মীর ভিড়
জাতীয় নির্বাচন শেষ। রাজপথে কোনো আন্দোলন নেই। রাজনৈতিক অঙ্গন অনেকটা শান্ত। তবুও আদালতপাড়ায় বিরোধী নেতাকর্মীর ভিড় কমছে না। নিয়মিত মামলা আর আত্মসমর্পণে প্রতিদিনই ছুটতে হচ্ছে এক আদালত থেকে আরেক আদালতে। কখনও উচ্চ আদালতে, আবার কখনও নিম্ন আদালতে। এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দা, এক আইনজীবীর চেম্বার থেকে আরেক আইনজীবীর চেম্বারে। এটাই এখন তাদের নিয়মিত কাজ। যারা কারাগারে আছেন, তাদেরও প্রায় একই অবস্থা। প্রায় প্রতিদিন প্রিজন ভ্যানে প্রচণ্ড গরমে গাদাগাদি করে নিয়ে আসা হয় আদালতে। অপেক্ষমাণ আইনজীবী, স্বজন ও কর্মীদের নিয়ে চালাতে হচ্ছে আইনি লড়াই।
আইনজীবী ও স্বজনরা জানান, জামিনের আশায় আদালতে গেলেও হতাশ হচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মী। জামিনযোগ্য হলেও বেশির ভাগ মামলায় আবেদন নামঞ্জুর করে পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক মামলায় উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিনের মেয়াদ শেষে নিম্ন আদালতে হাজির হলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারাগারে পাঠানো হয়।
তবে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, রাজনৈতিক হয়রানির জন্য কোনো মামলা পরিচালনা করা হয় না। বিএনপির অভিযোগ ভিত্তিহীন। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে।
গত মঙ্গলবার ঢাকার নিম্ন আদালতপাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, আদালতে হাজির করা হয়েছে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে। তিন মামলায় সাড়ে সাত বছরের সাজার রায় নিয়ে গত ২৯ এপ্রিল আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তিন শতাধিক রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। শুধু টুকুই নন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, বিএনপির সহস্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, নির্বাহী কমিটির সদস্য হাবিবুর রশিদ হাবিব, ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবিরসহ অনেককে নিয়মিত হাজিরা দিতে এদিন কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়।
কারাবন্দি নেতাদের বাইরে বিএনপি মহাসচিব থেকে শুরু করে স্থায়ী কমিটির সদস্য; কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। একই দিন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এসএম জিলানী, সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীরসহ অনেককে দেখা গেছে আদালতপাড়ায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান সমকালকে বলেন, বিরোধী দলকে দমনের জন্য হামলা-মামলা আর নির্যাতনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যার বিরুদ্ধে মামলা নেই। অনেকের বিরুদ্ধে মামলার পাহাড়।
আদালত অঙ্গনে কথা হয় যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবের স্বজনের সঙ্গে। ২০২৩ সালের ৩ মার্চ তাঁকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আটকের পর চার দফায় তাঁকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সাতটি মামলায় আদালত নীরবকে সাড়ে ২১ বছরের সাজা দেন বলে জানান তাঁর আইনজীবী ইনজামুল হক সুমন। গত ২০ মার্চ জামিন পান নীরব। কিন্তু তিনি মুক্তি পাননি, কারাফটক থেকে নতুন মামলায় আটক করা হয়। দ্বিতীয় দফায় গত ২৩ এপ্রিল জামিনে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কারাফটক থেকে নীরবকে ভিন্ন পুরোনো মামলায় আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিরবের এক স্বজন জানান, সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর অদৃশ্য ইশারায় তাঁর কারাবাস দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। তাঁকে বারবার কারাফটক থেকে আটক করে নির্যাতন করা হচ্ছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিরবের স্ত্রী মাহাবুবা খানম বলেন, ‘মুক্তির খবর পাওয়ার পর তাঁর তিন মেয়ের খুশির সীমা ছিল না। সেই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিছুক্ষণ পরেই খবর পাই, তাঁকে (নীরব) আবার আটক করা হয়েছে। পরপর দু’বার এমন ঘটনায় মেয়েদের মধ্যে প্রভাব পড়েছে। তিনি নিজেও প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় আছেন। এভাবে আর কতদিন?’
আদালতে কথা হয় সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর স্ত্রী সায়মা পারভীন সিম্মির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রিজন ভ্যানের গ্রিল দিয়ে স্বামীর মুখ দেখে বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। এর পর শুরু হয় এক আদালত থেকে আরেক আদালতে আনা-নেওয়ার কার্যক্রম। কখনও ১০ তলায়, কখনও আট তলা আবার কখনও অন্য ভবনে। তীব্র তাপদাহে শুধু টুকু নন, স্বজনরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুই মেয়ে আর এক ছেলে এটি সহ্য করতে পারবে না বলে তাদের আদালতে নিয়ে আসি না।’ তিনি আরও বলেন, ছয় বছর বয়সী ছেলে সাফারাত বিনতে সালাউদ্দিন বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না। নাওয়া-খাওয়া আর ঘুমের মধ্যে সে তার বাবাকে খুঁজে ফেরে। বছরখানেক ধরে মামলার কারণে ঘরছাড়া টুকু। আবার কবে মুক্ত জীবনে ফিরতে পারবেন, তা কেউ বলতে পারছে না।
গত ১৭ এপ্রিল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল। তাঁর বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা। গত নির্বাচনের আগে পাঁচ মামলায় ১৫ বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত। টেলিফোনে কথা হয় তাঁর স্ত্রী শামীমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, ঘরে তাঁর ৭ ও ৮ বছরের দুই কন্যা জাইফা ও জাহিয়া। সন্তানদের নিয়ে আদালত কিংবা কারাগারে দেখা করতে না যাওয়ার কথা বলেছেন জুয়েল। নির্দেশনা মানলেও প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় আছে সন্তানরা। দুই মেয়েকে ঘিরেই তাদের দু’জনের স্বর্গ। অথচ দুই কন্যা বাবাকে ছাড়া মনমরা হয়ে ঘরের এক কোণে বসে থাকে। কারও সঙ্গে কথা বলে না, খেলতে চায় না, ঘুরতেও যায় না। তাদের লেখাপড়ায়ও বিঘ্ন ঘটছে।
১৪৭টি মামলার মধ্যে তিন মামলায় ৬ বছর ৯ মাসের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গত ১৮ এপ্রিল আদালতে আত্মসমর্পণ করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি নেতা ও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিব। তাঁর স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোন সবাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। মা রহিমা খাতুন (৭৫) দেশে আছেন রাজনীতিপাগল হাবিবের জন্য। তিনি এখন অসুস্থ। ছেলেকে দেখতে আদালত কিংবা কারাগারে যেতে পারছেন না। কবে ছেলে মুক্তি পাবে, কবে তাঁকে আবার একটু আদর করতে পারবেন সেই প্রতীক্ষায় বসে থাকেন।
এই নেতারা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি শত শত বিএনপি নেতাকর্মী। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর বিভিন্ন মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এর মধ্যে গত ২৮ এপ্রিল রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির মকবুল ইসলাম টিপুসহ পাঁচজন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। একই দিনে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান (ভিপি মিজান), জেলা বিএনপির নেতা মোহিতুর রহমান হেলালসহ ১৪ জন; ২৪ এপ্রিল খুলনা জেলা বিএনপির ৩০ জন, ২১ এপ্রিল দিনাজপুরের ২৭ জন, ১৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য শহিদুল ইসলাম বাবুলসহ তিনজন, ১৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য লতিফুল্লাহ জাফরুসহ তিনজন, ৩০ এপ্রিল বরিশাল জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম জনি, ৬ মে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদল নেতা আব্দুস সালাম সিকদার আদালতে আত্মসমর্পণ করলে কারাগারে পাঠানো হয়।
এ ছাড়া বছরের পর বছর কারাবন্দি আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম পিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, নির্বাহী সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর, ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মিয়া নুরুদ্দিন অপু, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও কুমারখালী পৌর বিএনপির আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীর, প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ব্যক্তিগত সহকারী মনির হোসেনসহ অনেকে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, কারাগার যেন এখন বিএনপি নেতাকর্মীর স্থায়ী ঠিকানা। কয়েক হাজার নেতাকর্মী এখন বন্দি।-সমকাল
এবিসিবি/এমআই