Type to search

Lead Story সম্পাদকীয় ও মতামত

ভারতে ‘অনুপ্রবেশ’ করব কোন দুঃখে?

 

শেখ রোকন :

ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি অমিত অনিলচন্দ্র শাহ ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ বাংলাদেশ থেকে কথিত ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে আবার মুখ খুলেছেন। এক বৃহস্পতিবারেই পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও ঠাকুরনগরে অনুষ্ঠিত দুই দুটি জনসভায় তিনি বলছেন, রাজ্যটির আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়লাভ করলে এমন ব্যবস্থা করা হবে- বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত দিয়ে মানুষ দূরে থাক, পাখিও প্রবেশ করতে পারবে না। যদিও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার প্রথম বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- পানি, পবন ও পাখি সীমানা দিয়ে আটকানো যায় না (জুন, ২০১৫)। বাস্তবে যাই হোক, এর মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি তিনি প্রতিবেশীসুলভ সৌজন্যের বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশের প্রতি অমিত শাহের বাক-বিদ্বেষ অবশ্য নতুন নয়। ২০১৪ সালে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি হওয়ার পর থেকেই তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ‘বাংলাদেশ কার্ড’ খেলে যাচ্ছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১৫ সালে ডিব্রুগড় গিয়ে বলেছিলেন, আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ও মুসলিম সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক দল এআইইউডিএফ মিলে রাজ্যটির একটি অংশ ‘বাংলাদেশ বানাতে চায়’। পরের বছর ২০১৬ সালে, আসাম বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারণায় তিনি মাঠে নেমেছিলেন ‘অবৈধ বাংলাদেশি বহিস্কার’ ইস্যু নিয়ে। ২০১৭ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে ঢুকে জাতীয় নিরাপত্তা বিনষ্ট করছে। ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কথিত অভিবাসীদের সম্পর্কে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মন্তব্যটি করেন। ওই বছর সেপ্টেম্বরে রাজস্থানের গঙ্গাপুরে এক জনসভায় বলেন- এই উইপোকারা ভারতীয়দের রুটি-রুজি কেড়ে নিচ্ছে। ২০১৯ সালে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশিদের খুঁজে খুঁজে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আর কিছুদিন আগে, ২০২০ সালের নভেম্বরে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন- বাংলাদেশ থেকে ভোটার এসে ‘ছাপ্পা’ মেরে যায়। সীমান্ত সিল করে দেওয়া হবে, যাতে ‘মশা-মাছিও’ ঢুকতে না পারে।

দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই অমিত শাহ বাংলাদেশের ব্যাপারে ভিত্তিহীন ও অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কখনও কখনও বাংলাদেশের পক্ষে এর আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। খোদ ভারতের ভেতরেই তার এসব মন্তব্য নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। তারপরও তিনি কেবল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থেই একটি স্বাধীন দেশ সম্পর্কে চরম আপত্তিকর কথা-বার্তা বলছেন। খেয়াল করে দেখেছি, এসব বক্তব্যের বেশিরভাগই তিনি দিয়েছেন সেই বছরের শীতকাল অথবা তার আশপাশে। হতে পারে, শীতকালে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ জমে; হতে পারে, ভারতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নির্বাচনের মৌসুমের সঙ্গে শীতকালের কাকতাল রয়েছে; কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে শীতকালে বিভ্রান্তিকর কথা-বার্তা বলার অন্য অর্থ প্রচলিত।

কৌতুক থাক, গুরুতর প্রশ্ন করি- বাংলাদেশি নাগরিকরা ভারতে ‘অনুপ্রবেশ’ করতে যাবে কোন দুঃখে? যদিও স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে যাত্রা শুরু করেছিল; অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় নেয়নি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি- আমার মাতামহীর পিত্রালয় দেশভাগের চক্রে ভারতের অংশে পড়েছে। কৈশোরে আমরা তার সঙ্গে সেখানকার আত্মীয়স্বজনের কাছে বেড়াতে গেলে উপহার হিসেবে বাংলাদেশি সুগন্ধি সাবান, প্রসাধনী নিয়ে যেতাম। তারা খুব খুশি হতেন। কারণ সেখানে এত ‘উন্নত’ সামগ্রীর বড় অভাব।

বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক সূচকেও ভারতকে আমরা ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গিয়েছি। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনেক আগে থেকেই সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার তাদের সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখেছে- ‘২০২০ সালের শেষে, নাগরিকের গড় আয়ু ভারতের অপেক্ষা বাংলাদেশে তিন বৎসর বেশি, শিশুমৃত্যুর হার ভারতের অপেক্ষা কম (হাজারে ভারত ২৮, বাংলাদেশে ২৫), সাক্ষরতায় দুই দেশ পাশাপাশি, শহর-জনসংখ্যার হারে বাংলাদেশ (৩৭ শতাংশ) ও ভারত (৩৪ শতাংশ) এবং নারী কর্মসক্ষমতার দিক দিয়া বাংলাদেশ প্রভূত আগাইয়া (ভারত ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ)।’

 

সামাজিক ও মানবিক সূচকের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সূচকেও বাংলাদেশ যে ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট। গত অক্টোবরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তথা আইএমএফ বলেছে- মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বলছে- ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। এই পূর্বাভাস নিয়ে ভারতেই শুরু হয়েছিল তোলপাড়। তারপরও বাংলাদেশের নাগরিকরা আর্থিক ভাগ্যান্বেষণে ভারতে যাবে কেন?

আনন্দবাজারের আলোচ্য সম্পাদকীয়তে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বাক্য ছিল- ‘কে কোন দিকে অনুপ্রবেশ করিবে, তাহাই এখন প্রশ্ন।’ এর সমর্থন পাচ্ছি ঢাকার সংবাদমাধ্যমে দিল্লি প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে- “কিছু দিন আগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টেও দেখা গিয়েছিল, যত মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে গিয়ে ধরা পড়ছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি লোক আটক হচ্ছেন ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে। অর্থাৎ ‘নেট’ মাইগ্রেশন এখানে ভারত থেকে বাংলাদেশের দিকে; উল্টোটা নয়।” (বাংলা ট্রিবিউন, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)। ভারতীয় সংসদে উত্থাপিত এই তথ্যমতে এখন বরং বিজিবির উচিত সীমান্ত সিল করে দেওয়া, যাতে সীমান্তের ওপাশ থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ না ঘটে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা রয়েছে- ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এই দেশটিতে আমরা পর্যটনের জন্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনে যাই এবং অবশ্যই যাব। ভারতের ব্যুরো অব ইমিগ্রেশন দপ্তরের হিসাবমতে, দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পর্যটক যায় বাংলাদেশ থেকে। (বিবিসি বাংলা, ২১ এপ্রিল, ২০১৯)। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সাড়ে ২১ লাখের বেশি বাংলাদেশি পর্যটক ভিসায় ভারতে গেছে। যেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১৪ লাখেরও কম। এই বিপুলসংখ্যক পর্যটক ভারতের অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে, করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটকের অনুপস্থিতিতে কলকাতার পর্যটন এলাকাগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি দেখলেই তা খানিকটা বোঝা যায়।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক সম্পর্ক অগ্রাহ্য করার অবকাশ নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশটির অবদানের কথাও অবিস্মরণীয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ নিছক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে ভারতে ‘অনুপ্রবেশ’ করতে যাবে- এই বাস্তবতা অন্তত বর্তমানে নেই।

একটি পরিসংখ্যান দিয়ে শেষ করি। বিশ্বের কোন দেশে কত ভাগ মানুষ ‘উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ’ করে- এ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ যৌথভাবে সমীক্ষা প্রকাশ করে থাকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালেই বাংলাদেশে এই হার শূন্যে নেমে এসেছে। আর ভারতে এখনও ২৫ শতাংশের বেশি নাগরিক এ ‘পদ্ধতি’ অবলম্বন করে থাকে। অমিত শাহ তো বটেই, ভারতীয় পক্ষের সবাই এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন, ততই মঙ্গল। উভয় পক্ষের জন্যই।

শেখ রোকন, লেখক ও গবেষক
skrokon@gmail.com,

সৌজন্যে: সমকাল

Translate »