Type to search

কমিউনিটি জাতীয়

১১ বছর শ্রম ভিসার অপেক্ষায়: দক্ষ কর্মী চায় আমিরাত

কখনও প্রধানমন্ত্রীর সফর, কখনও মন্ত্রী পরিষদের উচ্চ পর্যায়ের সদস্যদের সফর; যা ঘিরে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) প্রবাসীরা আশায় বুক বাঁধতেন- এই বুঝি বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমিক ভিসা খুলে গেল। কিন্তু সেই সফর শেষের সঙ্গে সঙ্গে ফের হতাশায় ডুবে যেতেন প্রবাসী ও দেশটিতে নতুন করে কর্মের সন্ধানে যেতে আগ্রহীরা। দীর্ঘ এগারো বছরের এই অপেক্ষার অবসান হয়নি। জটিলতা কাটেনি বন্ধ শ্রম ভিসার।

২০১২ সালে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রম ভিসা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে দেশটি। এরপর শ্রম ভিসার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। তবে নানা সময় বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নেয়ার বিষয়ে আলোচনায় হয়েছে। এরমধ্যে পেশাদার ও উচ্চ শিক্ষিত কর্মীদের ভিসা এখনও দিচ্ছে আমিরাতের বাণিজ্যিক শহর দুবাই। এ ছাড়া করোনা পরবর্তী সময় কয়েক বছরে ভ্রমণ ভিসা নিয়েও দেশটিতে গিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি।

দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফর জানান, অদক্ষ শ্রমিকের বিষয়ে আমিরাত অনেকটা নিরুৎসাহিত করছে। দেশটিতে এখন অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। তবে দুবাইতে সার্ভিস সেক্টরে প্রচুর কর্মসংস্থান হচ্ছে। ব্যাংকার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, নার্স, আইসিটি, গ্রাজুয়েটরা এসব জায়গায় ভিসা পাচ্ছেন।

রাষ্ট্রদূত আবু জাফর বলেন, ‘তারা (আমিরাত) উন্নয়নের প্রায় শেষের দিকে। এখন তারা ধীরে ধীরে দক্ষ শ্রমিকের দিকে নজর দিচ্ছে। সেজন্য এই জায়গাগুলো শ্রমবাজারের জন্য সংকুচিত হবে। যদি আমরা অদক্ষ শ্রমিক তৈরি করি, তাহলে যেসব জায়গায় অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা আছে  শ্রমবাজারের নজর সেদিকে দিতে হবে।’

জানা গেছে, ২০১২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশিদের অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা বিবেচনায় নতুন শ্রম ভিসা প্রদান প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় দেশটি। একই ইস্যুতে আমিরাত ছাড়াও সেসময় মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে বাংলাদেশ মিশন থেকে বরাবরই বলা হয়েছে ‘বন্ধ নয়’ এই শ্রমবাজার, কমেছে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা। যেকারণে কয়েক দফায় দক্ষ শ্রমিক নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু নতুন শ্রমিক প্রবেশের সুযোগ না থাকায় এই শ্রমবাজার ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে। বাজার দখল করতে থাকে ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা ও নেপালের মতো দেশগুলো। প্রশিক্ষিত ও দক্ষকর্মী প্রেরণের কারণে আমিরাতের দৃষ্টিও এসব দেশের দিকে।

দেশটির বাংলাদেশ মিশন সূত্রে জানা যায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সার্বিক উন্নয়নের পর্যায় বিবেচনায় দেশটিতে এখন সাধারণ শ্রমিকের (অদক্ষ ও স্বল্পদক্ষ) চাহিদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তবে শুধুমাত্র দক্ষ ও পেশাজীবীদের জন্য কর্মসংস্থান ভিসার দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাব মতে, দক্ষ শ্রমিক ভিসা ও ভিজিট ভিসার সুবিধা নিয়ে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত আমিরাতে বাংলাদেশি কর্মী এসেছেন ৪২ হাজার ৬২৩ জন। গত বছর এসেছেন ১ লাখ ১ হাজার ৭৭৫ কর্মী। এর বাইরে ২০২০-২০২২ মেয়াদে ভ্রমণ ভিসা থেকে কর্মী ভিসায় রূপান্তরের সুযোগ নিয়ে প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি নাগরিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।

এদিকে, শ্রম ভিসা বন্ধ থাকলেও শুধুমাত্র দেশটির বাণিজ্যিক শহর দুবাইয়ে জন্য দক্ষ শ্রমিকের ভিসা পাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। যেসব ক্যাটাগরিতে ভিসা প্রদান করা হচ্ছে সেখানে শিক্ষাগত সনদ প্রদান বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। তন্মধ্যে পেশাদার ডাক্তার, প্রকৌশলী, হিসাবরক্ষকসহ বেশকয়েকটি ক্যাটাগরির ব্যবস্থাপক পদের ভিসা প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবসায়িক অংশীদার, বিনিয়োগকারী ও ১০ বছরের গোল্ডেন ভিসাও বাংলাদেশিদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। দুবাইয়ের বাইরে আবুধাবিসহ দেশটির বাকি ছয়টি প্রদেশে বাংলাদেশিদের জন্য তেমন কোনো ভিসার ব্যবস্থা নেই।

দুবাইয়ের দেরার একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ব্যবস্থাপক কামাল হোসেন খান সুমন জানান, আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন ধরনের ভিসা হচ্ছে। তারমধ্যে অধিকাংশই দক্ষ শ্রমিক ভিসা। বিশেষ করে যারা দেশ থেকে সরাসরি আসতে চান তাদের জন্য পেশাদার দক্ষ শ্রমিকের এই ভিসাগুলো চালু রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিজিট ভিসায় এসে এসব ভিসা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন বাংলাদেশিরা।

এদিকে দক্ষ শ্রমিক ভিসা প্রদানের এই সুযোগে একটি অসাধু মহল ভুয়া সনদ তৈরি করে অদক্ষ শ্রমিকদের দেশটিতে প্রেরণের অভিযোগ ওঠেছে। যা অদূর ভবিষ্যতে দেশটির শ্রমবাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে। যার ফলে নতুন করে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই শ্রমবাজার। এমনকি চলমান ভিসা প্রদান প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন মিশন কর্মকর্তারা। এই বিষয়ে সচেতন করতে ইতোমধ্যে কমিউনিটিভিত্তিক নানা আয়োজনে প্রবাসীদের সর্তক করছেন দেশটিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফর ও কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন।

দুবাই বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল বি এম জামাল হোসেন জানান, প্রতিদিন কনস্যুলেটে প্রায় ছয়’শ থেকে সাত’শ ভিসা সত্যায়নের আবেদন আসে। যার সবগুলো দক্ষ শ্রমিক ভিসা। কিন্তু ভিসা সত্যায়নের সময় শিক্ষাগত সনদ যাচাই করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে সেগুলো শতভাগই ভুয়া।

কনসাল জেনারেল বলেন, আমিরাতে দক্ষ শ্রমিক আসার সুযোগ রয়েছে, দক্ষতা থাকলে আসতে বাধা নেই। কিন্তু অদক্ষ শ্রমিকদের দক্ষ দেখিয়ে নিয়ে আসছে একটি অসাধু মহল। এতে দক্ষ শ্রমিকের ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা জানান তিনি।

অভিযোগ আছে, শ্রম ভিসা বন্ধের এই এগারো বছরে নানাভাবে দেশটিতে যতবার বাংলাদেশিরা যাবার সুযোগ হয়েছে, ততবারই দালাল ও বিভিন্ন অসাধু চক্র সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে বৃহত্তর এই শ্রমবাজারকে পুনরায় ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। করোনা পরবর্তী সময় আমিরাত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ ভিসা উন্মুক্ত করে দিলে এই ভিসা নিয়ে বহু বাংলাদেশি দেশটিতে পাড়ি দেন। পরে ভিসার ধরণ পরিবর্তন করে অনেকে কর্মসংস্থান ভিসাও গ্রহণ করেন। এই সুযোগে বাড়ে দালালদের দৌরাত্ম্য। কিছু অসাধু চক্র কাজ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশিদের থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এমন প্রতারণার শিকার হয়ে পরবর্তীতে কর্মহীন ও অসহায় জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে বহু বাংলাদেশিকে। পরে দেশটি বাংলাদেশিদের জন্য ভ্রমণ ভিসা থেকে সাধারণ কর্মী ভিসায় রূপান্তরের এই পথটিও বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে দুবাইয়ে দক্ষ শ্রমিক ভিসা প্রদানের সুযোগও একইভাবে অসাধু চক্র অপব্যবহার করছে।

গত অর্থবছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থ বছরের থেকে ৪৬ শতাংশ বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, রেমিট্যান্সের উর্ধ্বমুখী বৃহত্তর এই শ্রমবাজারের প্রাণ ফেরাতে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলোতে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে আসায় নতুন শ্রমিক প্রেরণের পূর্বে প্রশিক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত আবু জাফর বলেন, ‘যারা প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা, তারা প্রশিক্ষণ না নিয়ে ফাঁকিঝুঁকি দিয়ে সনদ নিয়ে চলে আসছেন। এসে এখানে কোনো কাজ পায় না। সার্টিফিকেট আছে, কিন্তু তাদের কোনো স্কিল নাই। দক্ষ শ্রমিকের সনদ আছে কিন্তু দক্ষতা নাই। যিনি স্কিল ক্যাটাগরির সার্টিফিকেট নেবেন, তার সেই কাজের দক্ষতা থাকতে হবে।’

এবিসিবি/এমআই

Translate »