Type to search

অর্থ ও বাণিজ্য রাজনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ!

উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তিটির মালিক বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৯৭০ সালের ৩০ জানুয়ারি জয়দেবপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সম্পত্তিটি সাফকবলা রেজিস্ট্রি (নং-১০৮২) হয়। যার বর্তমান বাজার মূল্য নিদেনপক্ষে ৫শ’ কোটি টাকা। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ‘ক্রয়’ দেখিয়ে এই সম্পত্তির দখলে এখন ‘জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস লি:’র। একাধিক দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে বন্ধক রাখা হয়েছে ব্যাংকে। অতি মূল্যায়নের মাধ্যমে একই সম্পত্তির একাধিক দলিল সৃষ্টি করে ঋণ নেয়া হয়েছে কয়েকটি ব্যাংক থেকে। এভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে নেয়া অর্থ লোপাটকারী মো: নূরুল ইসলামের হাতে শেখ হাসিনা একাধিকবার তুলে দিয়েছেন ‘জাতীয় রফতানি ট্রফি’। ‘রাষ্ট্রপতি শিল্প পদক’ও দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকবার। শেখ হাসিনার মাফিয়া শাসনামলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহে লুটতরাজের ক্ষুদ্রতম দৃষ্টান্ত এটি।

গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। তবে দেশে সুরক্ষিত রয়েছেন তার দীর্ঘ ফ্যাসিজমের গৌরিসেনরা। কিন্তু এই গৌরিসেনদের গ্রেফতারতো দূরের কথা, গায়ে সামান্যতম আঁচড়ও লাগেনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার গৌরিসেনরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। ঢাকতে চাইছেন হাসিনা আমলজুড়ে করা ব্যক্তিগত পাপ। আড়াল করতে চাইছেন হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অপরাধ। সুরক্ষায় মরিয়া হয়েছেন ব্যাংক লুটের অর্থে গড়ে তোলা অবৈধ সম্পদ-সাম্রাজ্য। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় অবিশ্বাস্য প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ঋণ লাভ থেকে শুরু করে নানা অনৈতিক সুবিধাগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব করলে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। অবিলম্বে উচিৎ তাদের গ্রেফতার করা। তাদের প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান অক্ষুণ্ন রাখতে অনতিবিলম্বে প্রশাসক নিয়োগ করা।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, হাসিনা সরকার আমলের সুবিধাভোগী লুটেরারাই বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার নামে নিজ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছেন। আদতে যা দিল্লিতে বসে কলকাঠি নাড়ানো শেখ হাসিনার খায়েশরই বাস্তবায়ন মাত্র।

দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানাযায়, গাজীপুর জেলাধীন টঙ্গি থানার ১৩২ নং পাগাড় মৌজার সি.এস. ও এসএ ৪১৭, ৪৮০, ৫০২, ৫০৪, ৫০৬, ৫০৭, ৫০৯, ৫১২ দাগের ২০ বিঘা সম্পত্তির মালিক ছিলেন পরেশনাথ সরকার গং। পরেশনাথ ১৯৭০ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন জয়দেবপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে ১০৮২ নম্বর দলিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’র কাছে সাফকবলা বিক্রি করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর উত্তরাধিকারসূত্রে ওই সম্পত্তির মালিকানা পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’। দেশের সরকারি, বেসরকারি, বিশেষায়িত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান,নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন। এছাড়া অর্থনৈতিক প্রতারণা, জালিয়াতি,পাচার ইত্যাদি মনিটর করাও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের এহেন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই করা হয়েছে এই অবিশ্বাস্য জালিয়াতি, প্রতারণা। একটি জালিয়াতি ও প্রতারণা আড়াল করতে করা হচ্ছে আরেকটি প্রতারণা। আর এসব প্রতারণার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও ঘুমে। শুধু তাই নয়- নিয়ন্ত্রক এই প্রতিষ্ঠানের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্র বিষয়টি জেনেও ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে দীর্ঘদিন। ভেতরে থেকে বছরের পর বছর সহযোগিতা করে যাচ্ছে জালিয়াত ও ব্যাংক লুটেরা প্রতিষ্ঠানটিকে।

অনুসন্ধানে প্রাপ্ত রেকর্ড বলছে, ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্ট অর্ডার (নং ১২৭) বলে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা হয় এই ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’। ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এর কার্যক্রম শুরুর তারিখ গণনা করা হয়। প্রেসিডেন্ট অর্ডারে ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’র ঢাকা শাখার সকল দায় ও পরিসম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যাত্রা। প্রতিষ্ঠাকালে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিলো ৩ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ মূলধনই সরকার পরিশোধ করেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের শতভাগ মালিকানা সরকারের। ব্যাংক পরিচালনার জন্য ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি পর্ষদ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর এ পর্ষদের সভাপতি। অন্যান্যরা হচ্ছেন একজন ডেপুটি গভর্ণর ও ৭ জন সদস্য। নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদন করে এই পর্ষদ। প্রতিষ্ঠাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ছিলেন, আ.ন.ম হামিদুল্লাহ (১৯৭২-৭৪)। পরে পর্যায়ক্রমে এ. কে. নাজিরউদ্দীন আহমেদ (১৯৭৪-৭৬), এম নূরুল ইসলাম (১৯৭৬-১৯৮৭), শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী (১৯৮৭-৯২), খোরশেদ আলম (১৯৯২-৯৬), লুৎফর রহমান সরকার (১৯৯৬-৯৮), ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (১৯৯৮-২০০১), ড. ফখরুদ্দীন আহমদ (২০০১-২০০৫), ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ (২০০৫-২০০৯), ড. আতিউর রহমান (২০০৯-২০১৬), ফজলে কবির (২০১৬-২০২২) দায়িত্ব পালন করেন। হাসিনার ফ্যাসিবাদের শেষ সময়টুকুতে ছিলেন আরেক দুর্নীতিবাজ আবদুর রউফ তালুকদার। এতোগুলো গভর্ণর দায়িত্ব পালন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’ বিলুপ্ত হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’। এর ফলে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের জনবল, দায় দেনা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে মতিঝিলে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়াও সারাদেশে ১০ টি শাখা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, মতিঝিল, সদরঘাট, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, সিলেট , রংপুর এবং ময়মনসিংহ। ঢাকার মিরপুরে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমি। বলাবাহুল্য,এসব স্থাপনা ব্যাংকটির নিজস্ব সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

এসব সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এ দুর্বলতার কারণে গাজীপুর জেলাধীন অন্ততঃ ২০ বিঘা সম্পত্তির তথ্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের অগোচরে থেকে যায়।
অনুসন্ধান মতে, ১৯৭০ সালের ৩০ জানুয়ারি ১০৮২ নম্বর দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তিটি খরিদ করেছিলো তৎকালীন ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’। কিন্তু জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া দলিল করে সেই সম্পত্তির দখল এখন নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ‘জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস লি:’র হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘নিখোঁজ’ সম্পত্তির হদিস জানতেন নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান মো: নূরুল ইসলাম। এটির প্রতি চোখ পড়ে তার। তাই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ‘খাড়া দলিল’ সৃষ্টি সম্পত্তিটি গ্রাস করেন তিনি। তারই প্রতিষ্ঠিত নোমান গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস লি:’, নাইস ডেনিম লিমিটেডসহ অন্ততঃ ৩৬টি প্রতিষ্ঠান।

প্রাপ্ত রেকর্ড বলছে, গাজীপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত ১০৮২ নম্বর দলিলে ‘দাতা’ দেখানো হয়েছে জনৈক গোলাম কবিরকে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়ীজ কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি’র পক্ষে গোলাম কবির ‘দাতা’ হিসেবে দলিলে স্বাক্ষর করেন। ‘গ্রহীতা’ দেখানো হয়, ঢাকার গুলশান ২৪ নং রোডের ৮৭ এভিনিউ নিবাসী মরহুম আব্দুস সামাদের পুত্র এসএমএ আহাদ এবং তার স্ত্রী আমিনা খাতুনকে। তাদের কাছ থেকে ১৯/১১/১৯৭৯ ইং তারিখে ঢাকা সদর রেজিস্ট্রি অফিসের একটি ‘ক্রয়’ দলিল (নং-৪৩১৯৫) করেন নূরুল ইসলাম। ওই দলিলের ফিরিস্তি ও মালিকানার ধারাবাহিকতায় গোলাম কবির খানকে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়ীজ কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি:’র পক্ষে ‘বিক্রেতা’ বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ গোলাম কবির ব্যক্তিগতভাবে একক ইচ্ছায় নিবন্ধিত একটি সমিতির সম্পত্তি বিক্রির কোনো এখতিয়ার রাখেন না। বিক্রি করতে হলে সমিতির সিদ্ধান্ত কিংবা রেজুলেশন প্রয়োজন। কিন্তু নূরুল ইসলাম দাবিকৃত বিক্রয় দলিলে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়ীজ কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি:’র পক্ষে গোলাম কবির কোন্ ক্ষমতাবলে দাতা হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন- সেটি উল্লেখ নেই। ‘ব্যাংক অব পাকিস্তান এমপ্লয়ীজ কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড’র পক্ষে সম্পত্তিটি কিনেছিলেন সমিতির চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা খানের পুত্র গোলাম কবির খান এবং সাধারণ সম্পাদক এ.এ. ফজলুল করিমের পুত্র বজলুল করিম। সমবায় আইন অনুযায়ী সম্পত্তি বিক্রি করতে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত আবশ্যক। অথচ দলিলে এমন কোনো রেফারেন্সের কথা উল্লেখ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তমূলক রেজুলেশন কিংবা রেফারেন্স খুঁজে পাওয়া যায়নি। রেজিস্ট্রার্ড ক্ষমতাপত্র (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হওয়ায় ৪৩১৯৫ নম্বর দলিলটি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। সহজভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, বিক্রয়-স্বত্ব নিশ্চিত না হওয়ায় গোলাম কবির কেমন করে ব্যাংক মালিকানাধীন সম্পত্তিটি ‘বিক্রি’ করেন ?

অনুসন্ধানে দেখা যায়, মরহুম মৌলভী গুলাম মোস্তফা খানের পুত্র গোলাম কবির ওরফে গোলাম কবির খান ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। তিনি ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানে ইন্তেকাল করেন বলে জানা যায়। দলিল সম্পাদনের তারিখ মৃত্যুর ৩ বছর পর, ১৯৭৯ সালের ১৯ নভেম্বর। তাহলে মৃত ব্যক্তি কি করে এই দলিলের ‘দাতা’ হন ? তাই নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম যে দলিলের ভিত্তিতে আহাদ ও আমিনা খাতুনকে দলিলের ‘দাতা’ দেখিয়েছেন সেটির সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, মো: নূরুল ইসলাম তফসিলে উল্লেখিত সম্পত্তি এসএমএ আহাদ ও আহাদের স্ত্রী আমিনা খাতুনের কাছ থেকে ১৯৯৬ সালের ১৬ জানুয়ারি পৃথক টঙ্গি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ২টি দলিলে (নং-২২৮ ও ২৩০) ‘ক্রয়’ দেখান। কিন্তু নূরুল ইসলামের সৃজনকৃত এ দলিলের সঠিকতা নিয়ে সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

দলিলে উল্লেখিত সম্পত্তি দখলে নিয়ে নূরুল ইসলাম এর ওপর স্থাপন করেন ‘নোমান স্পিনিং মিলস লি:’, ‘নোমান টেক্সটাইল মিলস লি:’ নামক ২টি প্রতিষ্ঠান। পরে ওই দলিলে উল্লেখিত সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন করে প্রতিষ্ঠান দু’টির নামে ইসলামী ব্যাংক লি: পল্টন শাখা থেকে অন্ততঃ দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন। কাগজপত্রের সঠিকতা যাচাই না করেই ব্যাংকের তৎকালীন কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা তাকে ঋণ প্রদানে সহযোগিতা করেন। এই সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক রাখার তথ্য গোপন করে ২০০৫ সালের ১৬ জুন নোমান গ্রুপেরই আরেক প্রতিষ্ঠান ‘জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিকস লি:’র কাছে পৃথক ২টি ‘বিক্রি’ দলিল (নং-২১৯১/২০০৫ ও ২১৯২/২০০৫) সৃষ্টি করেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দু’টি দলিলেরই ‘দাতা’ এবং ‘গ্রহীতা’ অভিন্ন ব্যক্তি। ‘দাতা’-‘গ্রহীতা’র উভয় কলামে কোম্পানির পক্ষে নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান মো: নূরুল ইসলাম স্বাক্ষর করেন। ‘জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিকস লি:’র নামে হওয়া দলিল দু’টি ব্যবহার করে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের দিলকুশাস্থ লোকাল শাখা থেকে আরও অন্ততঃ দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় নূরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান। দুই ব্যাংক থেকে পৃথকভাবে অন্ততঃ ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিপরীতে আরও ৪ হাজার কোটি টাকা ‘টার্ম লোনও’ নিয়েছেন-মর্মে তথ্য রয়েছে। আর অভিনব এই জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণে সহযোগিতা করেন ব্যাংকটির তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক, ক্রেডিট ডিভিশনের কর্মকর্তা এবং পরিচালনা পর্ষদের অসাধু কর্মকর্তারা।

গুরুতর এই জালিয়াতির বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমেছিলো দুর্নীতি দমন কমিশনের (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১) বিশেষ শাখা। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় গাজীপুর, টঙ্গি রাজস্ব সার্কেল থেকে রেকর্ডপত্র (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৪০৪.০১.০১০.২২.৩৫৬৫৫২/তারিখ : ২৬/০৯/২০২২) চাওয়া হয়। তবে নূরুল ইসলামের আওয়ামী প্রভাবে দুদকের সদস্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন অনুসন্ধানটি মামলা অবধি গড়াতে দেননি। জানাগেছে, শেখ হাসিনার আরেক দোসর দুদকের সাবেক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খানেরও হাত রয়েছে এ ঘটনায় মামলা না হওয়ার পেছনে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বিপুল অঙ্কের ঋণের বিপরীতে নূরুল ইসলাম যে সম্পত্তি জামানত রেখেছেন, সেটি যে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই সম্পত্তি-তা ওয়াকিবহাল নয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান কর্তৃপক্ষ। তবে রেকর্ডপত্র এবং একাধিক মামলায় এই সম্পত্তি ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পত্তি’ মর্মে উল্লেখ রয়েছে।

যেমন টঙ্গি পাগাড় হাউজিংয়ের কিছু সম্পত্তির মালিক দাবিদার কাজী মশিউর হোসেন দীপু একটি সিভিল রিভিশন (নং-১০৯০/২০১৩) করেন। ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন মামলাটির নম্বর ৯/২০১০। এ মামলায় উক্ত আদালত ১৪/০৫/২০১৩ ইং তারিখ একটি স্থিতাদেশ (স্ট্যাটাসকো ) দেন। সকলপক্ষকে স্থিতি অবস্থা বজায় রাখার জন্য আদেশে বলা হয়।

প্রথম মামলাটি (নং-১৬৫/১৯৭৩) ছিলো ঢাকা প্রথম সাব-জজ আদালতে। বাদী ছিলেন ইন্দ্র মোহন মন্ডল, নরেন্দ্র চন্দ্র সরকার গং। তারা মামলার বাদী। মামলার ১ নং বিবাদী হলেন কাজী এএসএম আব্দুল হালিম। মামলাটি পরে বদলি হয়ে প্রথম যুগ্ম-জজ আদালতে চলে যায়। সেখানে মামলাটির নতুন নম্বর (৪৯০/১৯৮৫) পড়ে। ওই মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়ীজ এসোসিয়েশনের এই সম্পত্তিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘নিজস্ব সম্পত্তি’ বলে দাবি করে। এখনও টঙ্গি এলাকায় ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পত্তি’ কোনটি-জানতে চাইলে স্থানীয়রা জাবের অ্যান্ড জোবায়েরের ফ্যাক্টরির ভেতরের জায়গাটি দেখিয়ে দেন। একটি দলিলের চৌহদ্দিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পত্তি রয়েছে-মর্মে উল্লেখ রয়েছে।

-ইনকিলাব

Translate »