চাল-তেলের বাজারে অস্থিরতা
এখন আমনের ভরা মৌসুম। নতুন ধানের চাল পুরোদমে বাজারে। শুল্ক কমে সর্বনিম্ন্ন। আমদানিও হচ্ছে চাল। বাজারে সরবরাহও পর্যাপ্ত। বাজার তদারকি চলছে। তবে দাম কমেনি বরং বেড়েছে। চলছে বাজারে অস্থিরতা। এক মাসের হিসাবে বেড়েছে দুই থেকে চার টাকা। মূলত অসাধু ব্যবসায়ী চক্র আর মিলারদের কারসাজিতে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্রমতে, বাজারে চালের ঘাটতি নেই। সরকারের চালের মজুত ও স্থানীয় উৎপাদন ও সংগ্রহে ঘাটতি নেই। আমনের ভরা মৌসুম চলছে। এরপরও চালের দাম বেড়ে যাওয়া অযৌক্তিক।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবি’র হিসাবে, এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম কেজিতে তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে। আর মাঝারি মানের চালের দাম কেজিতে দুই টাকা বেড়েছে।
এদিকে সংকট কাটছে না ভোজ্য তেলের বাজারে। বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা। আর পাঁচ লিটারের বিভিন্ন ব্রান্ডের সয়াবিন তেল বিক্রিমূল্য ৮৫০-৮৫৫ টাকা। এক মাস আগে দাম বাড়লেও সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকটের পাশাপাশি আবারো দাম বাড়ানোর পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে। এখনো বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক নয় বলে দাবি করছেন খুচরা বিক্রেতারা।
বুধবার এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, আমাদের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাজারে চালের কোনো ঘাটতি নেই। সরকারের নিজস্ব যে মজুত, সেখানেও ঘাটতি নেই, স্থানীয় উৎপাদনেও তেমন ঘাটতি নেই। এই মুহূর্তে বাজারে মূল্যস্ফীতির কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আমরা দেখছি না। আরেক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, চাল আমদানির শুল্ক কমিয়েছি। বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানি হচ্ছে। চালের দামের কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে আমাদের কাছে আলাদিনের চেরাগ নাই, যে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি।
চাল নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক: চালের মজুত ও আমদানি পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে চাল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দামের বড় ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। এর প্রকৃত কারণ জেনে সমাধান করা হবে। বলেন, সরকারি খাদ্য মজুত এখন ১২ লাখ টনের ওপরে। চলতি মাসেই মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন চাল আসবে। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশ থেকেও জিটুজি ভিত্তিতে চাল সংগ্রহের চেষ্টা চলমান।
দাম নিয়ন্ত্রণে চাল আমদানি বাড়াতে বলা হয়েছে: অর্থ উপদেষ্টা
চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেখান থেকেই হোক খাদ্য মন্ত্রণালয়কে চাল আমদানি বাড়াতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, চালের বাফার মজুত বাড়াতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে বিশেষ ওএমএস কার্যক্রম শুরু করা হবে।
চাল-তেলের আমদানি বেড়েছে: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ৫৫ হাজার ৯৩৯ টন চাল আমদানি হয়েছে। আগের মাস নভেম্বরে চাল আমদানি হয়েছিল মাত্র ৭ হাজার ৫০৭ টন। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে চালের আমদানি বেড়েছে ৬৪৫ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চাল আমদানি হয়েছিল মাত্র ১৭৮ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে চালের আমদানি বেড়েছে ৩১ হাজার ৩২৬ শতাংশ। এরপরও বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।
২০২৪ সালে ভোজ্য তেল আমদানি করা হয়েছে ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৩৫ টন, যা আগের বছরের একইসময়ে ছিল ১২ লাখ ৯৫ হাজার ৩৩৪ টন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে দেশে ভোজ্য তেল আমদানি করা হয়েছে ১৬ লাখ ৪২ হাজার ২৪৬ টন।
টিসিবি’র হিসাবে, মোটা চালের দাম বেড়েছে মূলত সর্বশেষ এক সপ্তাহে কেজিতে তিন থেকে চার টাকা। এ সময়ে মাঝারি চালের দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। সরু চালের দাম এক সপ্তাহে বাড়েনি। কিন্তু এক মাসের হিসাবে বেড়েছে দুই থেকে চার টাকা।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার গত ১৪ই নভেম্বর আশা প্রকাশ করেছিলেন, আমন ধান বাজারে এলে চালের দাম আস্তে আস্তে কমবে। যদিও চাল ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সাধারণত মৌসুমের সময় ধানের আমদানি বেশি থাকে। ফলে চালের দাম কমে যায়। কিন্তু এবার উল্টো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
চালের দাম কয়েক বছর ধরেই চড়া। সেটা আরও বেড়েছে। টিসিবি’র হিসাবে, মোটা চালের কেজি এখন ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা; যা এক বছর আগে ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। একইভাবে মাঝারি চালের দাম এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। এক বছর আগে ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, ধানের দাম বাড়ার ছুতা তুলে চালের দর বাড়াচ্ছেন মিলাররা। এভাবে দাম বাড়ার কারণে বিপাকে সাধারণ ক্রেতারা। ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের। খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি করছেন ৭৮ থেকে ৮০ টাকায়। আর নাজিরশাইল বিক্রি করছেন ৮০ থেকে ৮৬ টাকায়। ১৫ দিন আগেও মিনিকেট চাল ৬৮ থেকে ৭৫ টাকায় এবং নাজিরশাইল ৭০ থেকে ৭৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাবে দুই জাতের চালের কেজিতে বেড়েছে যথাক্রমে ৫ থেকে ১০ এবং ৮ থেকে ১০ টাকা।
বিআর-২৮ জাতের চালের কেজি দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। ২ থেকে ৫ টাকা দর বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। এ ছাড়া এ সময় মোটা চাল (গুটি স্বর্ণা) কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকার মতো। ১৫ দিন আগে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া মোটা চাল কিনতে এখন ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা। বাজারে ভারত থেকে আমদানি করা চালের সরবরাহও দেখা গেছে। মিনিকেট জাতের এ চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৬ থেকে ৭৮ টাকায়। কাওরান বাজারের চাল বিক্রেতা হেলাল বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই মিলাররা দর বাড়াচ্ছেন।
বাংলাদেশ অটো-মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, বিশ্ববাজারে এখন চালের দর অনেক বেশি। ভারত থেকে আমদানি করলে মোটা চালের দর পড়বে গড়ে ৬০ টাকার মতো। এজন্য আমদানিতে আগ্রহ কম।
ভারত থেকে আরও ৫০ হাজার টন চাল কিনবে সরকার: দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ভারত থেকে আরও ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতি কেজি চালের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ৫৫ টাকা ৬ পয়সা। এতে ৫০ হাজার টন চাল আমদানিতে ব্যয় হবে ২৭৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
৭ই জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এটিসহ এলএনজি ও কিছু অবকাঠামো সংক্রান্ত মোট চারটি ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে।
ফের ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা: রাজধানীর বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিলাররা তেল সরবরাহ কম করছে। আগে থেকে অর্ডার দিয়েও তেল পাচ্ছে না। গ্রাহকরা তেল চাইলে দেয়া যাচ্ছে না। তবে রমজানকে ঘিরে আরেক দফা দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মধুবাগের ব্যবসায়ী মাহাবুব বলেন, কয়েকদিন ধরে ডিলাররা তেল সরবরাহ করছে না। অর্ডার দিয়েও তেল পাচ্ছি না। গ্রাহকরা তেল চাচ্ছে দিতে পারছি না। একদফা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপরও সরবরাহ স্বাভাবিক নয়। শুনছি সামনে রমজানকে ঘিরে আরেক দফা দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে বড় ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পাইকারি বিক্রেতারা মনে করেন, বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট নেই। দাম ?বৃদ্ধির পর থেকে বাজারে ভোজ্য তেলের স্বাভাবিক সরবরাহ রয়েছে। আমরা চাহিদা অনুসারেই সরবরাহ করতে পারছি।
গত ৯ই ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি আট টাকা বেড়েছে। এরফলে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায়। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৭-১৬০ টাকা। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৭ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন ৮৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা।
সয়াবিন ও পামতেলের সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বমুখী দর বিবেচনায় নিয়ে পবিত্র রমজান মাসে পণ্যটির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার উদ্দেশ্যে কর অব্যাহতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সয়াবিন ও পাম তেলের অব্যাহতির মেয়াদ আগামী ৩১শে মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ভোজ্য তেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ মূসক ব্যতীত অন্য শুল্ক-করাদি প্রত্যাহার করা হয়। গত অক্টোবরে এমন আদেশ জারি করেছিল এনবিআর।
-মানবজমিন