Type to search

বাংলাদেশ রাজনীতি

শেখ হাসিনার অপরাধ তদন্তে বাংলাদেশে ট্রুথ কমিশন গঠনের পরামর্শ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-এবিসিবি নিউজ-abcb news

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের যে বন্দিশালায় আটক রাখা হতো তার নাম ছিল আয়নাঘর। সেখানে বন্দিদের অমানবিক অবস্থায় আটকে রাখা হতো। হাসিনার পতনের পর বের হতে শুরু করেছে আয়নাঘরের ভয়বাহ সব বর্ণনা। এক দশক ধরে গুম থাকা অনেককেই ওই বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন বয়সী ব্যক্তিদের আবাস হয়েছিল ওই ভয়ঙ্কর আয়নাঘরে। বেশ কয়েক বছর কর্তৃত্ববাদী শাসন শেষে শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতাচ্যুত। বলপূর্বক গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা এখন ন্যায়বিচার পেতে পারেন। কিন্তু শুধু বলপূর্বক গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য নয়, গত দুই দশকে সরকারের হাতে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছিলেন তাদেরও এখন ন্যায়বিচার প্রয়োজন।

২৯শে আগস্ট ‘বাংলাদেশ নিডস অ্যা ট্রু্রথ কমিশন ফর হাসিনা’স ক্রাইম’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশিয়া টাইমস। তাতেই এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আর বলা হয়, ন্যায়বিচার এবং সমন্বয়সাধন ছাড়া কোনো দেশ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা থেকে বের হতে পারে না।
অন্যভাবে বললে, বাংলাদেশের জনগণ সুস্থজীবন লাভের যোগ্য এবং এর জন্য তাদের সত্য ও ন্যায়বিচারের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। আর এ লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের প্রয়োজন ট্রুথ কমিশন গঠন করা। ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস রিসোর্স সেন্টারের মতে, ট্রু্রথ কমিশন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংগঠিত বলপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য অপরাধের সঠিক জবাব তুলে ধরে।
ট্রুথ কমিশনের একজন বিশেষজ্ঞ প্রিসিলা বি হায়নার। তার মতে, ট্রুথ কমিশনের চারটি উপাদান থাকে। ১. বিশেষ এই কমিশন বর্তমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিবর্তে অতীতে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে মনোনিবেশ করে। ২. কমিশনটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে একক কোনো বিষয়ের চেয়ে সময়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক চিত্র উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী হয়। ৩. অল্প সময়ের জন্য কাজ করলেও এই কমিশন তাদের ফলাফলের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে। ৪. তাদের কাছে সর্বদা এক ধরনের কর্তৃত্ব থাকে যা তাদের তথ্য এবং সুরক্ষা বিধানের অনুমতি দেয়। বিশেষ করে যখন তারা বলপূর্বক গুমের মতো কোনো সংবেদনশীল বিষয়গুলো তদন্ত করে।

ট্রুথ কমিশন এশিয়াতে নতুন কোনো ধারণা নয়। ২০১০ সালে দুর্নীতি দমনে ফিলিপাইনে এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশের (এনএইচআরসি) অধীনে এই কমিশন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যার উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশে যেসকল জোরপূর্বক গুম হয়েছে তার সঠিক তথ্য হাজির করা। এই কমিশনের আদর্শিক অবস্থা নিশ্চিত করতে স্বাধীন এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের নিয়োগ করা যেতে পারে, যারা জোরপূর্বক গুমের বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। অনেক আন্তর্জাতিক আইনজীবী এই গুরুত্বপূর্ণ সত্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে। সেখানে বর্ণবাদ কেন্দ্রিক যেসকল ঘটনা ঘটেছিল তা উদ্ঘাটনে তারা সাউথ আফ্রিকান ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (টিআরসি) গঠন করেছিল। ওই কমিশন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ সংক্রান্ত ১৩৭টি মামলার তদন্ত করে এবং তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্যদিকে কলম্বিয়ার সরকার এবং বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও ২০১৬ সালে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলম্বিয়ান ট্রুথ কমিশন, যার মধ্যে ৭০ এবং ৮০-এর দশকে ঘটে যাওয়া বলপূর্বক গুমের ঘটনা অনুসন্ধান করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে যে ট্রুথ কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে, তারা বলপূর্বক গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা স্থানীয় আদালতে অপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। এ ছাড়া এই কমিশন অপরাধীদের বিচারের জন্য নিজস্ব আদালতও গঠন করতে পারে। কলম্বিয়া কয়েক হাজার মানুষের হত্যার তদন্তের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন বিচার আদালত গঠন করেছিল। সে বিচারে এক সামরিক জেনারেলসহ আরও ১০ জন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছিলেন।
আর্জেন্টিনাও তাদের দেশে তথাকথিত একটি যুদ্ধের সময় ৩০ হাজারের বেশি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্ত করেছে। তদন্তের জন্য তারা একটি ট্রুথ কমিশন গঠন করেছিল। ওই কমিশনের মাধ্যমে সামরিক সদস্যদের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করে ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটি।
হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে যে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে তারা এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশকে এই কমিশন গঠনে সহায়তার জন্য আহ্বান জানাতে পারে। কেন না গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিবার কখনো কখনো সমগ্র দেশ এমন কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক আইন স্বীকৃত ক্ষতিপূরণের দাবি রাখে।

-মানবজমিন

Translate »