বিপক্ষে বিএনপি, পক্ষে জামায়াত

সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা ও সংস্কারের পরিধি নিয়ে চলমান বিতর্কের পাশাপাশি দ্বিমত-ভিন্নমত দেখা দিয়েছে সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন করা না করা নিয়েও। শুরু থেকেই বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামী বাইরে হরেক কথা বললেও আনুষ্ঠানিক সংলাপে বরাবরই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন ৩০০ আসন বিশিষ্ট নিম্নকক্ষ (আইনসভা) ও সেখানে আরও ১০০টি সংরক্ষিত আসন (নারীদের জন্য) এবং ১০০ আসন বিশিষ্ট উচ্চ কক্ষ সংসদের সুপারিশ করেছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই একমত। তবে, নিম্ন কক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই করার পক্ষে বিএনপি। অন্যদিকে, সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচনই পিআর পদ্ধতিতে চায় জামায়াত।
সর্বশেষ, শনিবার সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায়ও পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াত। এমনকি, সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রস্তাব দিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—এজন্য প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তিন দফায় আলোচনায় আগে সংসদ নির্বাচনের পক্ষে দলীয় অবস্থানের কথা জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে নিম্ন কক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই করার পক্ষে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেছে দলটি।
সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ করলেও নিম্নকক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই করার পক্ষে মত দিয়েছে, আর উচ্চ কক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক পদ্ধতিতে করার সুপারিশ করেছে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। তবে, জামায়াত সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচনই আনুপাতিক পদ্ধতিতে করার প্রস্তাব দিয়েছে।
উল্লেখ্য, সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হলো আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকবে না। ভোটাররা দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদের (নিম্ন কক্ষ) আসন বণ্টন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, যারা জনগণের প্রত্যক্ষ রায়কে ভয় পাচ্ছেন তারাই আনুপাতিক পদ্ধতির কথা বলছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি বিদ্যমান পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকেও আমরা একই কথা বলেছি। আমরা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছি। সেক্ষেত্রে নিম্ন কক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থায় করার কথা বলেছি। আর উচ্চ কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছে বিএনপি।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ ১৫ বছর সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। তারা সংসদ নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। কাজেই, সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তাব অবান্তর ও জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দল-জোটগুলোও। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এলডিপিসহ মিত্র দল-জোটগুলো বিএনপির অবস্থান বা প্রস্তাবের সঙ্গেই সহমত পোষণ করেছে। অন্যদিকে, এই দুটি ইস্যুতে চরমোনাই পিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামি রাজনৈতিক দল এবং তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থানের মিল রয়েছে জামায়াতের সঙ্গে। এই দলগুলোও আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন দাবি করছে।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে শনিবার আলোচনায় জামায়াতের পক্ষ থেকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা শুরু থেকেই যে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি, সেখানে আমরা পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের কথা বলেছি। বাংলাদেশের নির্বাচনে যে দুর্নীতি ও জবরদখল হচ্ছে এবং ভোটবিহীন নির্বাচনের যে ফলাফল হচ্ছে; পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার খেলাও বন্ধ হবে।’ পিআর পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে জামায়াতের এই নেতা এ-ও বলেন, পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশে এই পদ্ধতি চর্চা হচ্ছে। আগের দিন এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানও আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানান।
চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে গত বুধবার বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চেয়েছে গণঅধিকার পরিষদও। বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের বিষয়েও আমরা একমত হয়েছি।
ঐ বৈঠক শেষে ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদ অনেক আগে থেকেই একমত। গত আট মাসে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি না থাকায় সেবা পেতে মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। সেজন্য স্থানীয় নির্বাচন কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। তবে, এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন নুর।
-ইত্তেফাক