এতদিন পর ঘোষণাপত্র কেন— প্রশ্ন বিএনপির, প্রয়োজন দেখছে জামায়াত
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাড়ে পাঁচ মাস পর ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের প্রয়োজন হল কেন- এই প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। একইসঙ্গে সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটা করার ওপর জোর দিয়ে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে যেন ফাটল না ধরে সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। জামায়াত বলেছে, ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন রয়েছে, তবে তা হতে হবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। অন্য দলগুলোর পক্ষ থেকেও ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র তৈরির কথা বলা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকে অংশ নিয়ে তারা এমন মতামত দেন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এই বৈঠকে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও অংশীজনরা অংশ নেন। বৈঠকের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা, সবার মতামত প্রদান শেষে তিনি সমাপনী বক্তব্যও দেন। বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন। তবে আমন্ত্রণ পেলেও বৈঠকে যায়নি সিপিবি। আর আমন্ত্রণ না পাওয়ায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিএনপির মিত্র জোট ১২ দলীয় জোট।
বৈঠক শুরুর আগে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে দলটির চার সদস্যের প্রতিনিধি বৈঠকে যোগ দেন। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদও অংশ নেন। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে তিন সদস্য, ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে দুই সদস্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বৈঠকে অংশ নেন। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে তিন সদস্য, ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে দুই সদস্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বৈঠকে অংশ নেন। এছাড়া যোগ দেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও জাতীয় গণফ্রন্টের কামরুজ্জামান।
বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমির সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, মতবিনিময়ে যারা অংশ নিয়েছেন তারা বলেছেন- ঐকমত্য পোষণ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি ডকুমেন্ট প্রস্তুত করার জন্য সময় লাগুক, তাড়াহুড়া যেন না করা হয়, আবার অযথা কালক্ষেপণও যেন না করা হয়। কয়েকজন প্রস্তাব করেছেন- এই লক্ষ্যে সংগঠিতভাবে আলোচনা করার জন্য যেন একটি কমিটি গঠন করা হয়, সেই প্রস্তাবও এসেছে। তিনি বলেন, সব প্রস্তাব অ্যাক্টিভলি বিবেচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আসিফ নজরুল বলেন, ঘোষণাপত্র নিয়ে কতটা সময় নেওয়া যায়, সেটি আলোচনা করা হয়েছে। তবে, চেষ্টা করা হচ্ছে যেন অযথা কালবিলম্ব না হয়, সময়ক্ষেপণ না হয়। সবাই একমত হয়েছেন যে, সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে আরো নিবিড় আলোচনার করে এধরনের একটি ডকুমেন্ট প্রস্তুত হওয়া উচিত। সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এই প্রক্রিয়ায় আমরা সফল হবো। গণঅভ্যুত্থানকালে অটুট জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছি, সেই ঐক্যের ন্যারেটিভ সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রণয়ন করতে পারবো- সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে সভা শেষ হয়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনোরকম দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। শুধুমাত্র কী প্রক্রিয়ায় আলোচনা করা হবে, সেটা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত এসেছে। বিভিন্ন মতামতকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা কোথাও অনৈক্যের সুর দেখি না। বরং, সবাই মিলে যেন কাজ করা যায়, সবার মতামত যাতে প্রতিফলিত হয়, আমরা মনে করি এটি ঐক্যেকে আরো সুদৃঢ় করবে। তিনি বলেন, এটি নিয়ে আরো আলোচনা হতে পারে, কমিটি হতে পারে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হতে পারে। সেগুলোর বিষয়ে আমরা অ্যাক্টিভলি বিবেচনা করে ওনাদের পরামর্শের ভিত্তিতে একটা কর্মকৌশল ঠিক করবো।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে অংশ নেওয়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, গণঅভ্যুথানের সাড়ে পাঁচ মাস পর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের কি প্রয়োজন ছিল, বৈঠকে আমাদের পক্ষ থেকে সেটা বলেছি। বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমাদের রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে বিএনপি অবশ্যই সম্মান করে। কিন্তু, সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়, সেই পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঐক্যকে গণঐক্যে রূপান্তরিত করে সেটাকে আমরা যাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চর্চা করতে পারি, সেই ঐক্যকে ধরে রেখে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটাই আমাদের এখনকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য আমরা দিতে চাই। কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি বা ফ্যাসিবাদের দোসরেরা যাতে আমাদের ভেতরে অনৈক্যের বীজ বপন করতে না পারে, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আজ আমাদের আহ্বান করেছিলেন, আমরা এসেছি, কথা বলেছি। আমরা আমাদের পরামর্শ, রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব চিন্তাভাবনা আমাদের দেওয়া প্রয়োজন, সেটা আমরা দিয়েছি। এক্র প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসম্পর্কিত ঘোষণাপত্র নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের পরামর্শমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা প্রশ্ন করেছি, আসলে সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা। যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এবং আইনি গুরুত্ব কী, সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এ ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক দলিল প্রণয়নের বিষয়ে আমরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে কোনো আপত্তি আছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তর না দিয়েই সালাহউদ্দিন আহমদ চলে যান।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। ঘোষণাপত্র প্রয়োজন, সেবিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা করবো। তবে, এটা নিয়ে যেন জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট না হয়। হেফাজতের ইসলামের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্রে শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিষয় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ মামুন বলেন, ঘোষণাপত্র প্রণয়নের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠনের কথা বলেছেন তারা। জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের বলেন, ঘোষণাপত্র তৈরির পদ্ধতি কী হবে আমরা তা নিয়ে কথা বলেছি। এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, এটা হবে একটি ঐতিহাসিক দলিল।
এদিকে, গতকাল এক বার্তায় সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ‘আজ ১৬ জানুয়ারি বেলা ১টা ২৯ মিনিটে সিপিবির সাধারণ সম্পাদকের ফোনে নামবিহীন খুদে বার্তা পাঠিয়ে আগামীকাল বিকাল চার ঘটিকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে খসড়া ঘোষণাপত্র বিষয়ে আমাদের পর্যালোচনা উপস্থিত করতে বলা হয়। সঙ্গে ঘোষণাপত্র পাঠানো হয়। আমরা জানতে পারি, বৈঠকটি আগামীকালের নয়, আজ ১৬ জানুয়ারি বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে।’
অন্যদিকে, গতকাল রাজধানীর পুরানা পল্টনে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘আজকের সর্বদলীয় বৈঠকের ব্যাপারে ১২-দলীয় জোট কোনো বার্তা পায়নি। আন্দোলনের অনেক অংশীজনও আজকের সর্বদলীয় বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়নি। যেহেতু বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ, আমরা আশা করেছিলাম সরকার আন্দোলনের সব অংশীজনকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমন্ত্রণ জানাবেন। এক্ষেত্রে আমরা চরম আশাহত হয়েছি।’’
-ইত্তেফাক