হাসপাতালে করোনা রোগী কমেছে
বিশেষ প্রতিনিধি
করোনাভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কমেছে। নমুনা দিতে আসা মানুষের সংখ্যাও ছিল আগের তুলনায় কম। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৮১৩ রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের নীচে উঠানামা করছে। শেষ ২৫ দিনে ২৫ হাজার রোগী শনাক্ত হওয়ায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সোয়া পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। এ নিয়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৫ লাখ ২৫ হাজার ৭২৩ জনে। এই সময়ে প্রাণঘাতী ভাইরাসে আরও ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে মৃতের মোট সংখ্যা ৭ হাজার ৮৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম কিছুটা শিথিল করেছে সরকার। হোটেল বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকার বাধ্যবাধকতার সময় ১৪ দিন থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে চার দিনে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য থেকে যারা আসবেন, তাদের সবাইকে ৪ দিন বাধ্যতামূলকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
সারা বিশ্বের মতো করোনা ভ্যাকসিনের জন্য প্রহর গুণছে বাংলাদেশ। এই মাসের মধ্যেই করোনা ভ্যাকসিন দেশে আসছে। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, বেসরকারি উদ্যোগে করোনার টিকা আমদানি এবং কিভাবে প্রয়োগ হবে তা নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে করোনাভাইরাসের টিকার প্রয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে আয়োজিত সভা শেষে তিনি এ কথা বলেন।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকার মধ্যে ৫০ লাখ ডোজ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে। সবকিছু ঠিক থাকলে টিকা প্রয়োগ শুরু হবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। বাংলাদেশ সরকারকে এই টিকা সরবরাহ করবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রুয়ারি থেকে বেসরকারিভাবেও এই টিকা বিক্রি শুরু করবে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে।
বেসরকারিভাবে টিকা আমদানি ও প্রয়োগে নীতিমালা হচ্ছে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও করোনাভাইরাসের টিকা এনে তা সরবরাহ করতে পারবে। নীতিমালার মধ্যে সবকিছু থাকবে। তারা কিভাবে দেবে, কিভাবে হিসাব রাখবে, কি দামে দেবেন- এ বিষয়গুলো ঠিক করে দেবেন। এটাও ঠিক করে দেওয়া হবে হাসপাতালের মাধ্যমে, কোন ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মাধ্যমে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। মন্ত্রী জানান, করোনাভাইরাসের টিকা রাখার স্টোরেজের নিরাপত্তা বাড়ানো হচ্ছে। পুলিশ বা আনসার-এর নিরাপত্তায় থাকবে। এটাও বলেছি টিকা যেখানে রাখা হবে সেখানে ফ্রিজটা যেন ঠিকমতো চালু থাকে। বিদ্যুৎ যেন ঠিকমতো থাকে সেদিকেও নজর রাখা হবে। জাহিদ মালেক আরও বলেন, ফাইজারের টিকার জন্য কোভেক্স থেকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল তার জবাব পাঠানো হয়েছে। কোভেক্স থেকে ফাইজারের টিকা পেতে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে প্রায় ৪ লাখ লোককে দেওয়ার জন্য ৮ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে।
তিনি জানান, দেশজুড়ে করোনার টিকা দেওয়ার ৭ হাজার ৩৪৪টি দল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি দলে দুজন টিকাদান কর্মী এবং চার স্বেচ্ছাসেবক মিলে ছয়জন সদস্য থাকবেন। একটি দল প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন মানুষকে টিকা দিতে পারবে। সারাদেশে টিকাদান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুটি মনিটরিং সেল তৈরি করা হচ্ছে। শিগগিরই এই সেল কার্যক্রম শুরু করবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, ভ্যাকসিন সারাদেশে কি অবস্থায় আছে, কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, তাদের পরার্মশ দেওয়ার কাজ করবে এসব সেল। বেসরকারি খাতে টিকার বিষয়টিও মনিটরিং করবে তারা। বাংলাদেশে থাকা বিদেশি নাগরিকদেরও টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা টিকা দেব।
এদিকে বৃহস্পতিবার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দেশের কোভিড-১৯ সবশেষ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ৮৮৩ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এতে করে সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৪০৫ জন হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১১৫টি আরটি-পিসিআর ল্যাব, ২৮টি জিন-এক্সপার্ট ল্যাব ও ৫৬টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন ল্যাবে অর্থাৎ সর্বমোট ১৯৯টি ল্যাবে ১৬ হাজার ৬০৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৩৪ লাখ ১৮ হাজার ১১৪টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৬ লাখ ৯০ হাজার ১৩৩টি। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হয়েছে ৭ লাখ ২৭ হাজার ৯৮১টি। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ১১ জন পুরুষ আর নারী ৫ জন। তাদের মধ্যে সবাই হাসপাতালে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৯ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ৫ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এবং ২ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ছিল। মৃতদের মধ্যে ৯ জন ঢাকা বিভাগের, ৫ জন চট্টগ্রাম বিভাগের এবং ১ জন করে মোট ২ জন বরিশাল ও সিলেট বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।
দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ৭ হাজার ৮৪৯ জনের মধ্যে ৫ হাজার ৯৫৪ জনই পুরুষ এবং ১ হাজার ৮৯৫ জন নারী। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৩১৭ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। এ ছাড়াও ১ হাজার ৯৮০ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ৯০৯ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, ৩৮৭ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, ১৬১ জনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ৫৯ জনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এবং ৩৬ জনের বয়স ছিল ১০ বছরের কম। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩৪৫ জন ঢাকা বিভাগের, ১ হাজার ৪৪১ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৪৪৯ জন রাজশাহী বিভাগের, ৫৪১ জন খুলনা বিভাগের, ২৪০ জন বরিশাল বিভাগের, ৩০০ জন সিলেট বিভাগের, ৩৫০ জন রংপুর বিভাগের এবং ১৮৩ জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।
যুক্তরাজ্য ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন এখন ৪ দিন : সম্প্রতি করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক একটি নতুন ধরণ লন্ডন ও আশপাশের এলাকা থেকে দ্রুত ছড়াতে থাকে। গত মাসের শেষ দিকে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের ব্যাপারে সতর্কতা বাড়ানো হয়। এতদিন যুক্তরাজ্য ফেরত সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হচ্ছিল। এখন থেকে যুক্তরাজ্য থেকে যারা আসবেন, তাদের ৪ দিন বাধ্যতামূলকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। চারদিন পর নমুনা পরীক্ষায় করোনভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া না গেলে বাড়িতে গিয়ে তিনি বাকি ১০ দিনের কোয়ারেন্টাইন সম্পন্ন করবেন। আর চার দিন পর নমুনা পরীক্ষায় কারো সংক্রমণ ধরা পড়লে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন থেকে সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে আইসোলেশনে পাঠানো হবে। আজ শুক্রবার থেকেই নতুন এ নিয়ম কার্যকর হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার নির্দেশনায় জানানো হয়েছে।
২৩ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, যুক্তরাজ্য থেকে আসা যে যাত্রীর সঙ্গে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ‘নেগেটিভ’ সনদ থাকবে না, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সাত দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এরপর ২৮ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করে সরকার, তা কার্যকর হয় ১ জানুয়ারি থেকে। ওই ১৪ দিন যাত্রীদের নিজ খরচে সরকার নির্ধারিত হোটেলে রাখার ব্যবস্থা হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে। তা সোয়া ৫ লাখ পেরিয়ে যায় বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে গত ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু হয়। ২৯ ডিসেম্বর তা সাড়ে সাত হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু। বিশ্বে শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে সাড়ে ৯ কোটি ২ লাখ পেরিয়েছে। এই সময়ে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৯ লাখ ৩৫ হাজার। জনস হপকিন্স বিশ^বিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে শনাক্তের দিক থেকে ২৭তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৃতের সংখ্যায় রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে।