Type to search

জাতীয় বাংলাদেশ

মিয়ানমারে আটক ১৮ বাংলাদেশির ফেরার আকুতি

দেশি কিছু অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লোভের বলি হয়ে কয়েকশ’ প্রবাসীর জীবন এখন দুর্বিষহ। বিভিন্ন দেশের বিদ্রোহীদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এরমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার লাওস, কম্বোডিয়া, চীনসহ বিভিন্ন সীমান্তের গহিন অরণ্যে। থাইল্যান্ড সীমান্তের অদূরে মিয়ানমারের একাধিক স্ক্যাম সেন্টারে কয়েক মাস ধরে জিম্মি অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন ১৮ জন প্রবাসী বাংলাদেশি। নিকটজনের মাধ্যমে থাইল্যান্ডে মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের নিয়ে সেখানে জিম্মি করা হয়েছে। অন্ধকার যুগে মানুষকে যেভাবে ক্রয়-বিক্রয় করা হতো এখনো যুদ্ধ বা সংঘাতকবলিত এলাকায় তা-ই চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পেশাদাররা।

সেগুনবাগিচার এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে গতকাল বলেন- রিপোর্ট ভয়াবহ। বাংলাদেশি দালালদের মাধ্যমে প্রলুব্ধ হয়ে উন্নত জীবনের আশায় তারা আজ কঠিন পথে পড়েছেন। তাদের হয়তো উদ্ধার করা যাবে কিন্তু জীবন-ঝুঁকিতে পড়া এই পথসহ দুনিয়ার দেশে দেশে অবৈধ মানব পাচারের রুটগুলো বন্ধ করতে এখনই আন্তঃসরকার উদ্যোগ জোরদার  করা জরুরি। ঢাকায় প্রাপ্ত রিপোর্ট মতে, হাত বদলের পর স্ক্যাম সেন্টারগুলোতে জিম্মিদের ওপর চলে বর্বর নির্যাতন। বাংলাদেশিদের অবস্থাও তাই। প্রাণে বাঁচতে তারা বিভিন্ন মারফতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্ধারের আকুতি জানাচ্ছেন। কিন্তু দুর্গম এবং বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ থাকায় স্ক্যাম সেন্টারের রিয়েল টাইম পিকচার পাচ্ছে  না সরকার। তাদের উদ্ধারেরও কূলকিনারা নেই। এ বিষয়ে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মনোয়ার হোসেন সম্প্রতি ঢাকায় মানবজমিনকে বলেন, আমরা আমাদের মতো করে চেষ্টা চালাচ্ছি। মিয়ানমার সরকারকে বিষয়টি দফায় দফায় অবহিত করেছি। থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী ওই এলাকাটা কারেন বিদ্রোহীদের দখলে। স্ক্যাম সেন্টারগুলোর নিয়ন্ত্রণও তাদেরই হাতে। তাই এটা একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গেছে।

থাইল্যান্ডসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার তাদের উদ্ধারের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পূর্ব এশিয়া ড. নজরুল ইসলামও প্রায় অভিন্ন অভিমত দেন। অবশ্য অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনায় সবার আগে থাইল্যান্ডের সঙ্গে বোঝাপড়া জরুরি। কারণ তাদের অপরাধী চক্র বিদেশিদের চাকরির অফার করে প্রথমে থাইল্যান্ডে নেয়। সেখান থেকে মিয়ানমারের গহীন অরণ্যে পাচার করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। এটাকে ‘মানুষ  বিক্রি’ আখ্যা দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা নিশ্চিতভাবে থাইল্যন্ডের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের নলেজের বাইরে নয়। হয় তারা বিষয়টি ওভার লুক করে বখরার বিনিময়ে, অন্যথায় তারাই এই চক্রের পৃষ্ঠপোষক। সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে,   থাইল্যান্ড সীমান্তের গহীন অরণ্যে মিয়ানমার অংশে থাকা স্ক্যাম সেন্টারে জিম্মি বাংলাদেশিদের উদ্ধারকল্পে দফায় দফায় বৈঠক ও চিঠি চালাচালি হচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখনো নেই। সূত্রমতে, ওই স্ক্যাম সেন্টারগুলোর নিয়ন্ত্রক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকেন্দ্রিক একটি আন্তঃসীমান্ত অপরাধী চক্র। ওই অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সক্রিয় অবস্থানের সুযোগ নিয়ে তারা এটি গড়ে তুলেছে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় অনেকগুলো স্ক্যাম সেন্টারের অস্তিত্ব রয়েছে বলে রিপোর্ট পেয়েছে ঢাকা। রিপোর্ট মতে, অপরাধী চক্রটি বিভিন্ন দেশে মোটামুটি কম্পিউটার জানা লোকদের টার্গেট করে। তাদের বড় মাইনের চাকরি অফার করে নিটকজনকে দিয়ে। বিশ্বাস জন্মানোর জন্য তারা এমনটি করে। এরমধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি তাদের আকর্ষণ বা টার্গেট সবচেয়ে বেশি। যারা তাদের ফাঁদে পা দেয় তাদের প্রথমে ব্যাংকক নেয়া হয়। চূড়ান্ত গন্তব্য মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তের মিয়ানমার অংশে অবস্থিত স্ক্যাম সেন্টারগুলো।

সেখানে তাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হয় স্ক্যামিং ও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অনলাইনে অর্থ বিনিয়োগের জন্য পরিচিতদের প্রলুব্ধ করা। অনলাইনভিত্তিক ওই অপকর্মে অনেকে মজাও পেয়ে যায়। কিছুদিন তাদের ভালো বেতন দেয়া হয়। বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকের এন্ট্রিলেভেলে চাকরির সঙ্গে যেভাবে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া হয় সেভাবে তাদেরও একটি লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। সেটি অর্জনে ব্যর্থ হলেই নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে যা অবর্ণনীয়। তাদের জিম্মি করে স্বজনদের কাছ থেকেও অর্থ নেয়ার রেকর্ড রয়েছে। সূত্র বলছে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু কোনো অ্যাকশনে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করেছে। চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সংশ্লিষ্ট ওই এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে। তাই মিয়ানমার কারও বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। ঢাকা রিপোর্ট পেয়েছে, জিম্মি বাংলাদেশিরা যে স্ক্যাম সেন্টারগুলোতে আটকে আছেন তা থাইল্যান্ড সীমান্তের শো কেকো শহরে অবস্থিত। শহরটি কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন নামের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর দখলে। যাদের নিজস্ব কারেন ‘স্টেট বর্ডার গার্ড ফোর্স’ নামে একটি বাহিনী রয়েছে। ওই শহরে তাদের সদর দপ্তর। আন্তঃসীমান্ত অপরাধীদের কাছে বখরা আদায় তাদের আয়ের অন্যতম উৎস। আন্তর্জাতিক অপরাধ বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় এই অঞ্চল বহুমুখী অপরাধের ‘হাব’ হিসেবে কুখ্যাত।

পালিয়ে প্রাণে বাঁচা এক বাংলাদেশির বর্ণনা: সরকারি সূত্র বলছে, ওই স্ক্যাম সেন্টার থেকে বেশ ক’জন পালিয়ে কোনোমতে প্রাণে বাঁচতে পেরেছেন। তাদেরই একজন বেলাবো, নরসিংদীর মো. জুনায়েদ হোসেন। তার ভাষ্য মতে, ‘তিনিসহ পাঁচজন ফেনী জেলার ইফতেখারুল আলম রনি, (পাসর্পোট নং-অ ০৪৭৬১৭১৬, ঠিকানা: ফাজিলপুর, ওয়ার্ড নং-০৭, ফেনী সদর, ফাজিলপুর-৩৯০১, ফেনী) এর প্ররোচনায় বিগত ১২ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে দুবাই থেকে থাইল্যান্ড যান। এরপর তাদের একজনকে থাইল্যান্ডের মাইসর্ট শহরে মাসিক ১২০০ ডলার বেতনে কম্পিউটার অপারেটর পদের চাকরির অফার দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের থাই-মিয়ানমার সীমান্তের দুই নদী পার করে মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত স্ক্যাম সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কম্পিউটার সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের মাসে ১৫০০০ ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। ইলেকট্রিক শক ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গরম পানি ঢেলে নির্যাতন করা হতো। দেশে ফিরে আসার কথা বললে উপর্যুপরি নির্যাতন চালানো হতো। ভুক্তভোগী সুযোগ বুঝে মুই নদী পার হয়ে থাইল্যান্ড সীমান্তে ফিরে আসেন। এরপর থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং এনজিও’র সহায়তায় দেশে ফিরেন। তার বর্ণনায় বোঝা যায়, স্ক্যাম সেন্টারটি মিয়ানমারের ‘ডেমোক্রেটিক কারেন বোদ্ধিস্ট আর্মি’ নামের প্রতিষ্ঠিত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। স্ক্যাম সেন্টারে তাদের সশস্ত্র প্রহরা রয়েছে এবং স্ক্যাম সেন্টারের অবস্থান কিছুদিন পরপরই পরিবর্তন করা হয়। স্ক্যাম সেন্টারের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো চাইনিজ নাগরিকরা নিয়ন্ত্রণ করে।

ইয়াঙ্গুন মিশনের রিপোর্ট কি বলছে: ঢাকায় পাঠানো মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন মিশনের রিপোর্টে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সেইসঙ্গে মিশনের পদক্ষেপের খানিকটাও উল্লেখ ছিল। সেই রিপোর্ট মতে, আগস্ট-২০২৪ তারিখে ১৫ জন বাংলাদেশি নাগরিকের একটি তালিকা পায় বাংলাদেশ মিশন। যারা স্ক্যাম সেন্টারে আটক রয়েছেন। ১৫ জনের মধ্যে ৪ জনের দুবাইয়ে অবস্থানের ভিসা ছিল। বাকিরা বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যান। সেখান থেকে ভ্রমণ ভিসা জোগাড় করে থাইল্যান্ড পৌঁছান। ডেমোক্রেটিক কারেন বোদ্ধিস্ট আর্মি এবং থাইল্যান্ডের বর্ডার গার্ড সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করায় ভিসা ছাড়া লোকজন মিয়ানমারে প্রবেশ করতে পারে। ফলে মিয়ানমার ইমিগ্রেশনের কাছে বাংলাদেশি কতোজন প্রবেশ করলো সে তথ্য থাকে না। উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনভিত্তিক ফরেন ফান্ডেড এনজিও’র মাধ্যমে আটক ব্যক্তিদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে ঢাকাকে জানিয়েছে বাংলাদেশের ইয়াঙ্গুন মিশন।

-মানবজমিন

Translate »