চলতি বছরের এপ্রিলেই চলবে মেট্রোরেল
করোনা মহামারির কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও সঙ্কট কাটিয়ে ফের দ্রুতগতিতে চলছে মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আগামী ১৬ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চলেছে প্রকল্পের কাজ। তবে এপ্রিলে পরীক্ষামূলকভাবে চলবে মেট্রোরেল।
উত্তরার তিনটি স্টেশনে ট্রায়াল রানের পরিকল্পনা থাকলেও আরও দুটি বাড়িয়ে সংযুক্ত করা হবে মিরপুরকেও। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানান, উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার এবং উত্তরা দক্ষিণ- এই তিনটি স্টেশন নিয়েই ট্রায়াল রান করার পরিকল্পনা। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে বাড়িয়ে মিরপুর পর্যন্ত ট্রায়াল রান করার। তা হলে শহরের মধ্যে মানুষ ট্রেনগুলো দেখতে পারবে। এ লক্ষ্যে উত্তরার প্রথম তিনটি স্টেশনের পুরো কাজ দ্রুত শেষ করা হচ্ছে।
মেট্রোরেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মোট ১৬টি স্টেশনের প্রতিটির কাজই এখন চলমান। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটি প্লাটফর্মের অবকাঠামো শেষ। আর বাকিগুলোরও পিলার বসে গেছে। গত ডিসেম্বরেই প্রথম লটের পাঁচটি রেলকোচ জাপানে তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্পের ৫২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে অগ্রগতি প্রায় ৭৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্ধিত সময় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। করোনার সময় প্রথম কয়েক মাস কাজের গতি কম থাকায় মেট্রোরেলের ২০ কিলোমিটারের সম্পূর্ণ অংশ চালুর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তিতে ১৬ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেলের সম্পূর্ণ অংশের পরিবর্তে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর মতিঝিল পর্যন্ত চালু করতে আরও এক বছর সময় লাগতে পারে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মেট্রোরেল লাইন মতিঝিল থেকে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করার উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান তারা। এক্ষেত্রে কমলাপুর রেলস্টেশন ভেঙে পাশে প্রশস্ত করার প্রয়োজন হবে।
মেট্রোরেল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক জানান, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের মোট দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। স্টেশন রয়েছে ৯টি। ১১ দশমিক শূন্য ৪ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান। পাশাপাশি ৯০ মিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে।
এ ছাড়াও ৯টি স্টেশনের উপকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতি মাসে আমরা প্রকল্পের সবশেষ অগ্রগতি জানাই। প্রকল্পটি আটটি প্যাকেজে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই পরিষেবা স্থানান্তর, চেক বোরিং, টেস্ট পাইল, মূল পাইল, পাইল ক্যাপ, আই গার্ডার, প্রি-কাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিং ও পিয়ার হেড নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের ছাদ নির্মাণের কাজ চলছে। উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের প্লাটফর্ম নির্মাণকাজ সমাপ্ত। উত্তরা উত্তর স্টেশনের প্লাটফর্ম নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। উত্তরা উত্তর ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনে স্টিল স্ট্রাকচার ইরেকশন কাজ চলমান। উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন এবং স্টেশন কন্ট্রোলার কক্ষ নির্মাণকাজ চলমান।
মেট্রোরেল নির্মাণে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় তা বিবেচনায় পাঁচটি লং স্প্যান ব্যালান্স ক্যান্টিলিভারের মধ্যে তিনটি সমাপ্ত হয়েছে। ৭ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট রেললাইন ও ওভারহেড ক্যাটেনারিস সিস্টেম (ওসিএস) স্থাপনের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এমআরটি লাইন-৬ বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের সার্বিক গড় অগ্রগতি ৫২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৭৮ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণের জন্য আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজের অগ্রগতি ৪৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেলকোচ) ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সোশ্যাল স্টাডিও চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫২ দশমিক ১১ শতাংশ। কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল অংশের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
প্যাকেজ-৭-এর আওতায় ডিপো এলাকার ওয়ার্কশপ শেডের অভ্যন্তরে ১১টি রেললাইনের মধ্যে চারটি লাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। টঙ্গী ও মানিকনগর গ্রিড সাব-স্টেশন স্থাপন এবং উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাব-স্টেশনের পূর্ত কাজও শেষ। সাতটি লাইনে রেলট্র্যাক স্থাপনের কাজ চলমান। স্ট্যাবলিং শেডের অভ্যন্তরে ১০টি রেললাইনের মধ্যে পাঁচটি স্থাপনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই ডিপোতে ৮ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে।
ডিপোর অভ্যন্তরে রেললাইন স্থাপন কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৪০ শতাংশ। ভায়াডাক্টে ৩ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার ট্র্যাক প্লিথ কাস্টিং সম্পন্ন হয়েছে। এই প্যাকেজের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৫২ দশমকি ৫০ শতাংশ। মেট্রো ট্রেনের মকআপ গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে উত্তরা ডিপোতে এসে পৌঁছেছে। ছয়টি যাত্রীবাহী কোচ মেট্রো ট্রেন সেটের নির্মাণ গত মাসে জাপানে সম্পন্ন হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের উদ্বোধন করা হবে।
ঢাকার যানজট নিরসন ও নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক, দ্রুততর ও নির্বিঘ্ন করতে ২০১২ সালে গৃহীত হয় মেট্রোরেল প্রকল্প। ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। প্রত্যেকটি ট্রেনে থাকবে ছয়টি করে কোচ। যাত্রী নিয়ে ঘণ্টায় ১শ’ কিলোমিটার বেগে ছুটবে এই ট্রেন। উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহনে সক্ষমতা থাকবে মেট্রোরেলের। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।