Type to search

জাতীয়

সাক্ষী সুরক্ষা আইন আর কবে হবে?

৯ বছরেও হলো না সাক্ষী সুরক্ষা আইন

বিশেষ প্রতিনিধি : ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ শিরোনামে আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। আইনটি করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও আছে। কিন্তু প্রায় ৯ বছর কেটে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন।

সুরক্ষার অভাবে সাক্ষীরা আদালতে হাজির না হতে পারায় হত্যা, অস্ত্র, মাদক ও ধর্ষণসহ গুরুতর ও স্পর্শকাতর বহু মামলায় দাগী আসামিদের খালাস পাওয়াসহ মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। বিঘ্নিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাও।

সূত্র জানায়, সাক্ষী সুরক্ষা আইন করার জন্য আইন কমিশন ২০১১ সালের ৯ ফেব্রæয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ে একটি খসড়া পাঠায়। কমিশন তাদের সুপারিশমালায় সুরক্ষার অধিকার, সুরক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার, সুরক্ষা বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন সংস্থা, সুরক্ষা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্তির আবেদন, আবেদনের শর্তাবলী, সুরক্ষাপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) বা সাক্ষীর অধিকার, অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, অঙ্গীকার, নিরাপত্তাসহ ১৯টি সুপারিশ পাঠায় মন্ত্রণালয়ে।

‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়নে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়ন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা নিশ্চিত, রাষ্ট্র সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে অপরাধীরা সাক্ষ্যের অভাবে খালাস পেতে থাকবে, যা দেশের আইন, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি হবে। ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়ন ও মামলার সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য পৃথক স্থায়ী তদন্ত সংস্থা গঠনে সরকারকে জোর সুপারিশ করে আইন কমিশন।

সাক্ষী সুরক্ষা আইন করতে আইন কমিশনের পাঠানো খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে এখনও যাচাই-বাছাই পর্যায়ে আছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, সাক্ষী সুরক্ষা আইনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। আইনটি করার ক্ষেত্রে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাষ্ট্রের সামর্থ্য থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। তাই খুবই ঠান্ডা মাথায় আইনটি করতে হবে। আশা করি, গুরুত্বপূর্ণ এ আইন করতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না। তবে আর কত দিন সময় লাগতে পারে সে বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, নির্দিষ্ট করে এটা বলতে পারব না।

আইন কমিশন থেকে যখন এই সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইনটি দ্রুত প্রণয়ন করা দরকার। আমরা সুপারিশ পাওয়ার পর খসড়া আকারে তৈরি করে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি।

২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর সাক্ষী সুরক্ষা আইন করার উদ্যোগ নিতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এবং নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ আইন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

একটি হত্যা মামলায় ছয় বছরে একজনও সাক্ষ্য না দেওয়ায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ওই আদেশ দেন। সাক্ষী সুরক্ষা আইনে নির্ধারিত তারিখে সমন পাওয়ার পরও সাক্ষী উপস্থিত না হলে সে বিষয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর এবং পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জবাবদিহির আওতায় আনার বিধি রাখতে বলেন আদালত।

পরে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের জন্য ‘সাক্ষী ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’র একটি খসড়া প্রকাশ করে সুপ্রিমকোর্ট। যাতে বলা হয়, অধস্তন আদালত বা ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলার সাক্ষীকে তলব করা হলে সে দিনই তার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন করতে হবে। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না করে তাকে ফেরত পাঠানো যাবে না। শুধু তা-ই নয়, কোনো সাক্ষী হুমকিতে থাকলে তিনি মুখোশ পরে কিংবা কাঠগড়ার পাশে অস্বচ্ছ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিতে পারবেন।

এতে বলা হয়, নীতিমালার উদ্দেশ্য, সাক্ষ্য ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করে মামলাজট, সময় ও ব্যয় কমানো এবং সাক্ষীদের বারবার উপস্থিতি রোধ করা।’ সর্বোচ্চ আদালতের ওয়েবসাইটে ১৯ পৃষ্ঠার এ খসড়াটি প্রকাশ করা হয়েছিল।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ বলেন, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও আইনের শাসনে দুর্বলতার কারণে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে সাহস পায় না। এ কারণে দ্রুত সাক্ষী সুরক্ষা আইনটি করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সাক্ষীদের কী ধরনের সুরক্ষা দেওয়া হবে সেটিও স্পষ্ট করতে হবে।

মনজিল মোরসেদ বলেন, বিচার প্রার্থীদের বিচার পাওয়ার জন্য এবং দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য সাক্ষী সুরক্ষা আইনের বিকল্প নেই।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের জ্যেষ্ঠ সদস্য প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, গত ১০ বছরে ট্রাইব্যুনাল থেকে ৪১টি মামলার রায় হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল ৯৬ জন; যার মধ্যে ৭০ জনেরই মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়েছে। তবে বর্তমানে আমরা সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে বেশি চিন্তিত।

তিনি বলেন, ১০ বছরে বিভিন্ন মামলায় চারশ সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমাদের সাক্ষীরা অধিকাংশ অত্যন্ত গরিব। অনেক সময় দেখি আসামিরা দুইতলা-তিনতলা বাড়িতে থাকে। অথচ সাক্ষীদের কুঁড়েঘরও নেই। অনেক সময় আমাদের সাক্ষীদের নিয়ে প্রশাসনের লোকেরাও টিটকারি করেন। এ ক্ষেত্রে সাক্ষীদের সুরক্ষা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এসব ভিকটিমের পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসে না। তাদের প্রতিটিক্ষণ কাটে আতঙ্কে। সাক্ষীরা ফোন দিয়ে নানা অভিযোগ করেন।

হায়দার আলী বলেন, একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অপরাধীর সাজা হয়। এ কারণে সাক্ষীদের ওপর সবসময় একটি বাড়তি চাপ থাকে। যে কারণে সাক্ষী সুরক্ষা আইনটি এখন সব থেকে বেশি জরুরি।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, অনেক অস্ত্র, মাদক ও ধর্ষণ মামলায় শুধু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভয়-ভীতি দেখান সাক্ষীদের, যাতে সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে না যান। আবার সময়মতো সাক্ষী না আসায় এসব মামলার বিচার থেমে থাকে বছরের পর বছর। তাই দ্রুত সাক্ষী সুরক্ষা আইন হওয়া জরুরি।

Translate »