Type to search

জাতীয়

শাবাশ বাংলাদেশ : পদ্মার বুকে মর্যাদার স্তম্ভ

প্রমত্ত পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে নিজেদের সামর্থ্যের অভূতপূর্ব এক দৃঢ়তা দেখাল বাংলাদেশ। স্থাপিত হয়েছে আমাদের মর্যাদার স্তম্ভ। সব চ্যালেঞ্জ উতরে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে পদ্মার দুই পাড়ের।

দেশের দক্ষিণ জনপদের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে যে বিপুল কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল পদ্মাপাড়ে, তা পূর্ণ অবয়ব পেয়েছে বৃহস্পতিবার। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর সাহাসী পদক্ষেপে নিজেদের অর্থায়নে নির্মিত হলো দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো- স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

দুপুর ১২টা ২ মিনিটে সেতুর মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ঠিকঠাক বসে যায় টু-এফ নম্বরের শেষ স্প্যানটি। এর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এই সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যমান হলো; তৈরি হলো রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগের পথ। তবে সেতুটি এখনই উন্মুক্ত হচ্ছে না যান চলাচলের জন্য।

আগামী বছরের ডিসেম্বের এই সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। চলছিল জোর প্রস্তুতি। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে তা পিছিয়ে যাচ্ছে আরও কিছুদিন। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালে নয়, ২০২২ সালে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে দেশের সর্ববৃহৎ সেতুটি। কোনো একটি বিশেষ দিনে এটি উদ্বোধন করা হতে পারে।

বৃহস্পতিবার সেতুর শেষ স্প্যান বসানোর মাহেন্দ্রক্ষণ ঘিরে পদ্মাপাড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। কেবল পদ্মার দুই তীরের বাসিন্দারা নন, ঢাকা থেকেও অনেকে যান সেতুর শেষ স্প্যানটি বসানোর কাজ নিজের চোখে দেখতে। নৌকা, ট্রলার ও স্পিডবোট ভাড়া করে তারা নদীতে স্প্যানটির কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান নেন। শেষ স্প্যানটি বসানো হয়ে গেলে উল্লাস প্রকাশ করেন তারা।

মাঝনদীতে পদ্মার সর্বশেষ স্প্যান দেখতে জলযান নিয়ে ভিড় জমায় অনেক মানুষ। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মাদারীপুর যাওয়ার পথে পদ্মা সেতুর নিচে কিছুক্ষণের জন্য থেকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। অন্যের মুখাপেক্ষী না থেকে বাংলাদেশ যে নিজেই কিছু করে দেখাতে পারে, পদ্মা সেতুকে তারই প্রমাণ হিসেবে অভিহিত করেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ^কে দেখিয়েছে, আমরা পারি। বাংলাদেশের পক্ষে এখন সব অসাধ্য সাধন সম্ভব।

দক্ষিণাঞ্চলকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করার এই যে মহাযজ্ঞ, সেটা খুব সহজ ছিল না। দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এই অবকাঠামো গড়তে ছিল বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপে সে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে নিজেদের অর্থায়নেই শুরু হয় পদ্মা সেতুর কাজ। তারপর ছিল প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ- মোট ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো তৈরি হয়।

কিন্তু মাঝে ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া গেলে নকশা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। পরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। তাতে বাড়তি সময় লেগে যায় প্রায় এক বছর। এরপর করোনাভাইরাস মহামারি আর বন্যার কারণে কাজের গতি কমে যায়। সব বাধা পেরিয়ে অক্টোবরে বসানো হয় ৩২তম স্প্যান। এরপর বাকি স্প্যানগুলো বসানো হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। সবকিছু জয় করেই শেষ পর্যন্ত গড়ে তোলা হয় এই সেতু। স্বপ্নের এই সেতুটি যেন যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হয় এর নকশায়।

পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আবদুল কাদের জানান, এখন দ্বিতল এই সেতুর ঢালাইয়ের কাজ, অ্যাপ্রোচ রোড ও ভায়াডাক্ট প্রস্তুত করা, রেলের জন্য স্ল্যাব বসানো হয়ে গেলেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের উপযোগী হবে।

৩ হাজার ২০০ টন ওজনের ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্প্যানটি মাওয়ার কুমারভোগের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে নিয়ে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির কাছে পৌঁছে যায় ভাসমান ক্রেন ‘তিয়ান ই’। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় হালকা কুয়াশার মধ্যেই ইঞ্চি মেপে শুরু হয় স্প্যান স্থাপনের কাজ। দুপুর ১২টা ২ মিনিটে সেই কাজ শেষ হলেই মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত পদ্মার এপার-ওপার যুক্ত হয়ে যায় বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী।

যে ৪১টি স্প্যান দিয়ে পুরো পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ২০টি বসানো হয়েছে, আর মাওয়া প্রান্তে বসানো হয়েছে ২০টি স্প্যান। একটি স্প্যান বসেছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝখানে।

দ্বিতল এই সেতুতে স্প্যানের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ হলেই পিচ ঢালাই হবে। ২২ মিটার প্রশস্ত এই সেতুতে চার লেনে যানবাহন চলতে পারবে। আর নিচ দিয়ে এক লাইনে চলবে ট্রেন। ওই এক লাইনেই মিটারগেজ ও ব্রডগেজ- দুই ধরনের ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা হচ্ছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য (মুন্সীগঞ্জ-২) অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করে বাঙালি বিশে^র সামনে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিল। এর মূলে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এই সেতু বাস্তবায়নে যাদের ত্যাগ, শ্রম, ঘাম রয়েছে, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, এই সেতুর সুফল ভোগ করবে পুরো জাতি।

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ^ব্যাংক। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে থাকে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন করে পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্বব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে।

এরপর পদ্মা সেতুতে ‘সম্ভাব্য দুর্নীতির’ অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংককে ‘না’ বলে দেয়। সেই টানাপড়েনে একজন মন্ত্রীকে সরে যেতে হয়, তখনকার সেতু সচিবকে দুদকের মামলায় কারাগারেও যেতে হয়। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে সেই মামলায় পরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় দুদক। কানাডার আদালতেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত নকশা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় সেই বিপুল কর্মযজ্ঞ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় প্রথম স্প্যান।

২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর নামফলক উন্মোচনের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্প কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দৃঢ়তা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’- এটিই আমরা প্রমাণ করেছি। পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরু করে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি আমরা পারি। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।

মূল সেতু নির্মাণের কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি কোম্পানি সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড।

সিনোহাইড্রো করপোরেশনই পদ্মা সেতুর জন্য নদীশাসনের কাজ করছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত সে কাজের ৭৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছিল।

৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মোংলাবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তাতে মোট দেশজ উৎপাদন এক দশমিক দুই শতাংশ বাড়বে এবং প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমবে বলে সরকার আশা করছে।

Translate »