Type to search

জাতীয় বাংলাদেশ

ট্রাম্পের সাহায্য স্থগিত, বাংলাদেশে মার্কিন কর্মসূচি পুনর্গঠনের সুযোগ

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যখন ২০ জানুয়ারি সমস্ত মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা স্থগিত করার ঘোষণা দেয়, তখন বহিষ্কৃত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে কাজ করা বৈশ্বিক নেটওয়ার্কগুলো তা শুনে আনন্দিত হয়েছিল। নয়া দিল্লির নির্দেশে কাজ করা ভারতীয় ডানপন্থী মিডিয়া ভাষ্যকারদের এই নেটওয়ার্কটি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নতুন ট্রাম্প সরকারের অসন্তুষ্টির চিহ্ন হিসেবে এই পদক্ষেপকে চিহ্নিত করতে শুরু করে। কিন্তু শিগগিরই তারা বুঝতে পারে যে, বাংলাদেশই একমাত্র নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের তথাকথিত ‘মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা শিল্প’ থেকে বাদ পড়েছে। ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহায়তা পেত এবং দেশটির এনজিওগুলোর জন্যও এই সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে।

আমি যখন এক্স -এ বিষয়টি তুলে ধরি, তখন ভারতের অতি-জাতীয়তাবাদী ভাষ্যকাররা কয়েকদিন ধরে একে ‘ভুয়া খবর’ বলে তীব্র উপহাস করতে থাকে। এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি সংকটময় মুহূর্ত। বাংলাদেশে উন্নয়ন সহায়তা বন্ধের বাস্তব প্রভাবকে খাটো করে দেখলে চলবে না। সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর এর প্রভাব পড়বে। যদিও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, তবে অন্যান্য কর্মসূচি যেমন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং শিক্ষা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) দ্বারা অর্থায়ন করা হয়েছিল, এখন আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে একটি স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থার ১,০০০-এর বেশি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন, কারণ তারা ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন।

বিশ্বব্যাপী সহায়তা কর্মসূচিগুলোকে নতুন মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেয়া হয়নি। বরং নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকে এ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছিল। মাইক্রো লেভেলে এর প্রভাব সবথেকে বেশি। তবে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ককে শুধুমাত্র সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ভাবলে ভুল হবে। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি, আমেরিকায় বসবাসকারী নাগরিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স এবং বিশ্বব্যাংকের মতো মার্কিন-প্রভাবিত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেয়া ঋণ—এসবই দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্য ও অভিবাসন সংক্রান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের আসন্ন নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো সহায়তা বন্ধের চেয়ে ওয়াশিংটন-ঢাকা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর সম্ভাব্যভাবে বেশি প্রভাব ফেলবে।  যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কতটা প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। কারণ এটি শুল্ক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত।

অভিবাসন সীমিত করা এবং অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হলে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে পারে। এর ওপর যদি যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি কর্মীদের পাঠানো অর্থের ওপর কর বসানো হয়, তাহলে রেমিট্যান্স আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাহায্যে বন্ধের ৯০-দিন বিরতির পরে কী হবে তা যে কারও অনুমানযোগ্য, এমনকি একটি স্বাধীন সংস্থা হিসাবে USAID-এর ভবিষ্যত এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বৈদেশিক সহায়তা নীতির সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়, ট্রাম্প প্রশাসনের মার্কিন মিত্রদের সাথেও আলোচনা করা উচিত। বিশেষ করে কোয়াড জোটের দেশ— ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এই আলোচনা জরুরি। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ অবস্থিত হওয়ায়,  চীনের প্রভাব মোকাবিলা করতে কোয়াড সদস্যদের উচিত ঢাকার জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা আরও বাড়ানো। বিশেষ করে জাপানের এগিয়ে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সহায়তার ঘাটতি পূরণেও সহায়ক হতে পারে।

অনেক বিশ্লেষক যখন ঢাকা-ওয়াশিংটনের সহায়তা স্থগিত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তখন দুই দেশের সম্প্রসারিত বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। একটি মার্কিন কোম্পানি ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সাথে একটি নতুন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দ্বিতীয়ত, একজন ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী, যিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিলো তা দেখে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তবে বিনিয়োগের প্রতি সাম্প্রতিক আগ্রহ দেখে বোঝা যায় যে,  বাংলাদেশে ব্যবসা ও রাজনীতির পরিবেশ ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাণিজ্য বাড়ানো ও মার্কিন বিনিয়োগ আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। গত মাসে দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতো মঞ্চে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে আলাপচারিতা করেন।  অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সহায়তার চেয়ে বাণিজ্যই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধন করে। তাই বিদেশি সাহায্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করা সঠিক পথ নয় এবং এটি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। সহায়তা স্থগিতের ৯০ দিনের ধোঁয়াশা কেটে গেলে বাংলাদেশের জন্য মার্কিন বিনিয়োগ কোন খাতে আসবে তা সামগ্রিক নগদ ডলারের পরিমাণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সহায়তা কর্মসূচি সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের পর্যালোচনা করা উচিত।

গণতন্ত্রের জন্য অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দিন

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করার জন্য প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেয়ার এটি একটি সুযোগ। যা এই সংকটময় সময়ে বাংলাদেশের মানুষের চাহিদাকে আরও ভালোভাবে পূরণ করবে। একইভাবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের জেনারেশন জেডের সাথে জড়িত থাকার উপর আরও বেশি ফোকাস করা সম্ভবত বিনিয়োগে একটি বড় রিটার্ন প্রদান করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং সারা দেশে ছড়িয়ে দেন তাদের মধ্যে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্কতা ছিল। এটি  বাংলাদেশের তরুণদের ক্ষমতাকে  কাজে লাগানোর গুরুত্ব তুলে ধরে। তাদের প্রয়োজন বুঝে  কর্মসূচি তৈরি করা উচিত, যাতে তারা বাংলাদেশ, এশিয়া তথা বিশ্বজুড়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে । সেইসঙ্গে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পথপ্রদর্শক হতে পারে।

সূত্র : বেনার নিউজ

লেখক জন ড্যানিলোভিজ হলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সিনিয়র ফরেন সার্ভিস অফিসার যার দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে  ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার কূটনৈতিক কর্মজীবনে তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

Translate »