Type to search

জাতীয় বাংলাদেশ

জুলাই গণহত্যায় জড়িতদের বিচারসহ ৪১ সুপারিশ জাতিসংঘের

ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে নির্বিচারে হত্যার ঘটনায় নির্দেশদাতা এবং নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাসহ ৪১ সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে স্বাধীন তদন্তে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, বিজিবি, আনসার-ভিডিপি এবং সশস্ত্র বাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে তাদের অপসারণ করতে বলা হয়েছে। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর তৎপরতা ও ক্ষমতা সীমিত করার পরামর্শ দিয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি নিয়ে তৈরি করা এ প্রতিবেদন বুধবার প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় র‌্যাব বিলুপ্ত এবং র‌্যাবের যারা গুরুতর মানবাধিকার সঙ্গে জড়িত নয় তাদের নিজ নিজ ইউনিটে ফিরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। র‌্যাব, ডিজিএফআই, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা এবং বিজিবি ব্যাটালিয়নে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা এবং ২০২৪ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতরা জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী মিশনে যেতে পারবে না বলেও প্রতিবেদনে উল্লে­খ করা হয়েছে।

এতে ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মডেল বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপের কথা বলা হয়েছে। অবাধ ও প্রকৃত নির্বাচনের জন্য নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ঋণ আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিতদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন কঠোর ও সমভাবে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক, সংখ্যালঘু নেতা, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক বা রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশকারীরা যেন অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, সেই সুপারিশও করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জবাবদিহিতা ও বিচার বিভাগ, পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগ, নাগরিক পরিসর, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সুশাসন খাতে মোট ৪১টি সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে সুপারিশ অংশের শুরুতেই বলা হয়েছে, জুলাই আন্দোলনে গুরুতর আহতদের অনেকেই জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলকে জানান যে, দেশের প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য এবং বাংলাদেশের সব নাগরিকের স্বাধীনতা, সমতা এবং ন্যায্য সুযোগের জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এ ধরনের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন বলেও জাতিসংঘকে জানান তারা। প্রতিবেদনে ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও বিচার ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারে জোর দেওয়া হয়েছে। সরকারের উদ্দেশে বলা হয়েছে, নিপীড়নমূলক আইনগুলো বাতিল এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে সাজান যাতে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির নিরসন ও ভিন্নমতগুলো প্রকাশ করা যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কথাও বলা হয়েছে।

জবাবদিহিতা এবং বিচার বিভাগ : সুপারিশে বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, আইনের অপব্যবহার, জোরপূর্বক গুম এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সমন্বিত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করুন; যেসব অপরাধী নির্দেশদাতা ও নেতৃত্বদানকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে তাদের বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে জবাবদিহি নিশ্চিত করুন। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কার্যকর প্রতিকার এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করুন।

জুলাই আন্দোলন দমনে সরকারি আদেশ এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ নথি এবং ফরেনসিক প্রমাণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। এসব প্রমাণ যারা লুকানো ও নষ্টের চেষ্টা করেছে বা নষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিচারের আওতায় আনতে বলা হয়েছে। সাক্ষী সুরক্ষার ওপর দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা আইনি প্রণয়ন এবং জরুরি ভিত্তিতে ভিকটিম এবং সাক্ষী সুরক্ষা প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৩২ ধারা এবং অন্যান্য অনুরূপ আইনে যে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারের পথ উন্মুক্ত করতে বলা হয়েছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে বলা হয়েছে, আইনে এবং প্রয়োগিক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিপর্যায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করুন। বিচারকদের নিয়োগ, বরখাস্ত, প্রত্যাহার এবং শৃঙ্খলা সম্পর্কিত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি দায়িত্বশীল স্বাধীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করুন, যাতে করে বিচারকরা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, ভয়ভীতি এবং হয়রানিসহ অপ্রত্যাশিত বা অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা পান। বিচারকদের জন্য পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা এবং বিচারকদের চাকরির মেয়াদ শেষ না পর্যন্ত অবসর গ্রহণের মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয় তা নিশ্চিত করুন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড বিধান স্থগিত করুন।

পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগ : পুলিশের প্রবিধানগুলো সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মারণাস্ত্র না দেওয়ার জন্য। গণ-অভিযোগ এবং গণ-গ্রেফতার চর্চা বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিষেধ) আইনের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যতামূলক আদেশ জারি করতে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সুশীল সমাজসহ সরকার, বিরোধী দল এবং স্বাধীন সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন করুন, যার নেতৃত্বে একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং যোগ্যতাভিত্তিক পুলিশ নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং অপসারণ প্রক্রিয়া চালু করতে উদ্যোগ নিন। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বিলুপ্ত করুন এবং গুরুতর লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত নয় এমন কর্মীদের নিজ নিজ ইউনিটে ফিরিয়ে দিন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কাজগুলোকে সীমানা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা এবং ডিজিএফআইকে সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করুন।

নাগরিক পরিসর : সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০২৩, অফিশিয়াল গোপনীয় আইন, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ আইন, ফৌজদারি মানহানিসহ দণ্ডবিধির বিভিন্ন বিধিবিধান রহিত করুন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ বিচারিক তদারকি নিশ্চিত করুন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন দ্বারা সুরক্ষিত আচরণের ক্ষেত্রে সাংবাদিক, আইনজীবী, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, সুশীল সমাজ কর্মী এবং অন্যান্য মানবাধিকার রক্ষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিচারাধীন ফৌজদারি মামলাগুলো প্রত্যাহার করুন। এটা নিশ্চিত করুন যে সাংবাদিক, আওয়ামী লীগ সমর্থক, সংখ্যালঘু নেতা, মানবাধিকার কর্মী এবং নাগরিক বা রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশকারী অন্যরা নির্বিচারে যেন গ্রেফতার, অপ্রমাণিত ফৌজদারি মামলা বা অন্যান্য ধরনের ভয়ভীতির শিকার না হন। প্রতিশোধমূলক সহিংসতার বিরুদ্ধে তাদের কার্যকর সুরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিন।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা : মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা সাপেক্ষে অবাধ ও প্রকৃত নির্বাচনের জন্য একটি নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করুন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ বিশেষত নির্বাচনের আগের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করুন। যেসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচন পরিবীক্ষণ করে তাদের সক্ষমতা বাড়ান, এতে শাসন কাজে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবে ভারসাম্য সমুন্নত হবে। মানবাধিকার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিচালন ব্যবস্থা উন্নয়নে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা শুরু করুন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকুন।

অর্থনৈতিক সুশাসন : অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সুপারিশে বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করে ঋণ আত্মসাৎ এবং অন্যান্য বৃহৎ মাপের দুর্নীতি স্কিম থেকে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করুন। দুর্নীতিবিরোধী আইন কঠোরভাবে এবং সমভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে তা নিশ্চিত করুন। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বিশেষ করে উচ্চস্তরের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বিচার করুন। দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্যদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করুন এবং পর্যাপ্ত আইনকর্মীদের সংখ্যা বাড়ানোসহ এর স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করুন। সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করুন। ব্যবসায়ী জোট ও গোষ্ঠীবাদী অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণকারীদের বিরুদ্বে জরুরিভিত্তিতে আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার উন্নয়ন করুন।

-যুগান্তর

Translate »