কোভিড-১৯: শক্তভাবে লকডাউন কার্যকর করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

দেশে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আবারো শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (২৫ জুন) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একদিনের পরিসংখ্যানে এটা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। কোভিড-১৯ দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হলে গত ১৭ এপ্রিল প্রথমবারের মতো দৈনিক মৃত্যু একশ ছাড়িয়ে যায়। টানা ৩দিন একশর উপরে মৃত্যুর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং এর মধ্যে ১৯ এপ্রিল ১১২ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয় যা এখন পর্যন্ত দেশে ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এরপর গত ২৫ এপ্রিল ১০১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়। সেই হিসাবে গতকাল ৫ম দিন একশ জনের উপরে মৃতের তথ্য দেওয়া হলো। দেশে এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৯৭৬ জনের মৃত্যু হলো করোনায়। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানান, স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা না হলে সামনে মৃত্যু আরো বাড়বে। করোনায় সংক্রমণের উপর মৃত্যুর সংখ্যা নির্ভর করে। জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবা না পেয়ে রোগীরা সব রাজধানীতে আসছে। আসা-যাওয়ার পথে অনেক মানুষকে তারা সংক্রমিত করছে। এ কারণে ঢাকাকে রক্ষা করা কঠিন হবে। করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন শক্তভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
কোভিড-১৯ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৪০টি জেলা। এরমধ্যে উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সীমান্তবর্তী জেলাও রয়েছে। এসব জেলা ও এর আওতাধীন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন ও বেডের সংকট প্রকট। হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা কেন বাড়েনি এমন প্রশ্ন রাখেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, লকডাউন ও শাটডাউনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেউই তা মানছে না। ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় লকডাউন দেওয়া হলেও মানুষের চলাচল বন্ধ হয়নি। সামনে ঈদে লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত হবে। তখন করোনা পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মানুষকে স্বাস্থবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। আর সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাসহ সবার সম্পৃক্ত করে লকডাউন ঘোষণা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনায় মৃত্যু তিন সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় সতর্কবার্তা। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। সবার মাস্ক পরতে হবে। বিশ্বের ১৩০টি দেশ টিকা পায়নি। তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাহলে আমরা কেন পারবো না? জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে না পারলে সামনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।
করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, সামনে ঈদে কয়েক কোটি মানুষের যাতায়াত হবে, এ কারণে করোনা সংক্রমণ আরো বাড়বে। আর আক্রান্তের সংখ্যার উপর মৃত্যুর হার নির্ভর করে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সীমান্তবর্তী জেলা-উপজেলাসহ উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ জেলা-উপজেলায় চিকিত্সা সেবা না পেয়ে মানুষ ঢাকায় আসছে।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, সামনে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত দুটিই বাড়বে। অতীতের ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। লকডাউন কেউ মানে না। সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। কোন কোন অফিস অর্ধেক খোলা। সাত জেলায় লকডাউন দেওয়া হলেও ওই সব জেলাগুলোতে আগের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। মানুষের মুভমেন্ট বন্ধ হয়নি। লকডাউন হতে হবে লকডাউনের মতো। জরুরি সার্ভিস ও রোগীর যাতায়াত ছাড়া সব কিছু বন্ধ রাখতে হবে। মন্ত্রী, এমপিসহ সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশনসহ সবাইকে সম্পৃক্ত করে লকডাউন ঘোষণা করতে হবে, যাতে তা বাস্তবায়ন করা যায়।
কোভিড হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও কোভিড-১৯ গাইডলাইন কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. একে আজাদ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করার পাশাপাশি ৪০টি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলাতে জরুরি ভিত্তিতে চিকিত্সা সেবার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যে যেখানে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাকে সেখানে চিকিত্সা সেবা দিতে পারলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। কারণ চিকিত্সা নিতে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে গিয়ে রোগীরা অন্যদের সংক্রমিত করছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন আরও ৫ হাজার ৮৬৯ জন। এ নিয়ে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল আট লাখ ৭৮ হাজার ৮০৪ জনে। গতকাল নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ২১ দশমিক ২২ শতাংশ। গত ৬৯ দিনের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। গত ১৭ এপ্রিল শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক ৪৬। মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৭৭৬ জন। এ নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা সাত লাখ ৯৭ হাজার ৫৫৯ জন। সুস্থতার হার ৯০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মৃত ১০৮ জনের মধ্যে দশোর্ধ্ব একজন, বিশোর্ধ্ব ২ জন, ত্রিশোর্ধ্ব ৭ জন, চল্লিশোর্ধ্ব ১৫ জন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ২৫ জন এবং ষাটোর্ধ্ব ৫৮ জন রয়েছেন।বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মৃত ১০৮ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৫ জন, চট্টগ্রামে ২৩, রাজশাহীতে ১৬, খুলনায় ২৭, সিলেটে ৩, রংপুরে ১০ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪ জনের মৃত্যু হয়। তবে বরিশাল বিভাগে কেউ মারা যাননি।