Type to search

Lead Story জাতীয়

ব্যয় বাড়াতেই মেয়াদ বাড়ে নানা প্রকল্পের

প্রকল্প-এবিসিবি নিউজ-abcb news

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতায় চার লেন ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পটি কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের জুনে। ২০১৩ সালে একনেকে অনুমোদন পাওয়া ২৪০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পর খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৩ কোটি ২৭ লাখ টাকায়। একইভাবে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণ কাজ চলছে ১০ বছর ধরে। এখন আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি খরচও বাড়ানো হচ্ছে।

২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদনকালে ব্যয় ধরা হয় ৩৭৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২০১৫ ও ২০১৮ সালে দুই দফায় প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সড়ক বিভাগের প্রায় সব প্রকল্পেরই এভাবে মেয়াদ বাড়িয়ে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এতে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, নির্ধারিত সময়ে উন্নয়ন প্রকল্প শেষ না করাটাই সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের এক ধরনের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন নেওয়ার পর সেটি আর অনুমোদিত মেয়াদে শেষ করা হয় না। ফলে খরচ বাড়ে।

এ নিয়ে সম্প্রতি একনেক বৈঠকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় বৈঠকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর জন্য কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেছেন। ছোট প্রকল্পগুলোতেও মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

একনেক বৈঠকে সংশোধনের জন্য তোলা ‘চরখালী-তুষখালী-মঠবাড়িয়া-পাথরঘাটা সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ’ প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেন। ২০১৭ সালে পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া ও মঠবাড়িয়া উপজেলা এবং বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সড়ক প্রশস্ত করতে ১০৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল এক বছর মেয়াদে। এখন প্রকল্পের ব্যয় ১৪৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় উন্নীত করে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

ছোট প্রকল্পগুলোতেও মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়ে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সব প্রকল্পে এমন দেরি হয় কেন? সব প্রকল্প যেন যথাসময়ে শেষ হয় সেই ব্যবস্থা নিন। কেন বিলম্ব হচ্ছে, সেটার কারণ অনুসন্ধান করুন।’

সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় প্রকল্পের অনিয়ম তদন্ত শুরু করে। এতে দেখা যায়, সড়ক বিভাগের কোনো প্রকল্পই যথাসময়ে শেষ করা হয়নি। ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে খরচও। বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করেও সড়কের কাজ শেষ না হওয়া এবং কাজের নিম্নগতির পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। তদন্তে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের বরিশাল জোনের অধীনে ‘চরখালী-তুষখালী-মঠবাড়িয়া-পাথরঘাটা সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ’ প্রকল্পে অনিয়ম ও কর্মকর্তাদের দায়িত্বে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পাশাপাশি নকশা ত্রুটি, ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে কাজে ধীরগতি ও নিম্নমানের কাজ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সময় অপচয়ের কারণে দায়ীদের শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়।

তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বলেছে, চরখালী-তুষখালী-মঠবাড়িয়া-পাথরঘাটা প্রকল্পের প্যাকেজ ৫-এর ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশন হলেও তারা নিজস্ব যন্ত্রপাতি ও জনবল ব্যতীত অনুমতি ছাড়াই স্থানীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজটি পরিচালনা করছে। ৮৬৩ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও এ প্যাকেজের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৩৬ শতাংশ। এ কারণে তমা কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে জামানত বাজেয়াপ্ত করতে বলা হয়। ঠিকাদারের অনুমোদনহীন কার্যাদি জেনেও বিষয়টি প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি ও সময়ের অপচয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল তিন বছরে। ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদনের পর ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ৪শ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতুর মূল স্প্যান হবে ৯০ মিটারের। সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য হবে ২ দশমিক ১৩ কিলোমিটার। এখন আরও দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি খরচও বাড়াতে হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শীতলক্ষ্যার ওপর ছয় লেনের সেতু হবে। সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে উপজেলার। তা ছাড়া নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর সঙ্গে বাইপাসের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়কে সংযোগ স্থাপিত হবে।

এ প্রকল্পে ঠিকাদারের নির্মাণ কাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক বছরের পরামর্শক খাতের জন্য ৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। গত মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৭২ শতাংশ। এ প্রকল্প নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দেয় মন্ত্রণালয়।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রকৌশলীরা জানান, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় নির্মাণাধীন গুরুত্বপূর্ণ সেতুটির মেয়াদ বাড়ানোসহ কিছু সংশোধনী এসেছে। প্রকল্পটি নির্মাণ কাজের বর্ধিত শেষ সময় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হলেও করোনার কারণে নির্মাণ কাজ ব্যাহত হওয়ায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনা করে এখন আরও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এরপর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড হিসেবে আরও এক বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়েছে। প্রকল্পের আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করতে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করে এখন ডিপিপি সংশোধন করা হবে।

অন্যদিকে সিলেট জোনের ১৪৮ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পটি ৫৬০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে একনেক কর্তৃক জুলাই ২০১৭ হতে জুন ২০২০ পর্যন্ত মেয়াদে অনুমোদিত হয়। পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন মেয়াদকাল আরও এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর বলেন, গুনগতমান বজায় রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করতে না পারলে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রয়োজনবোধে চুক্তি বাতিল করার বিষয়ে সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ যাতে যথাসময়ে শেষ করা হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সমন্বয় সভায় বলেছেন, অভিযোগ আছে প্রকৌশলী-ঠিকাদার যোগসাজশে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সময়মতো কাজ শেষ করে না ব্যয় বাড়ানোর জন্য। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা নষ্ট হয়, অর্থের অপচয় তো হয়ই। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মধ্যমেয়াদি বাজেট পরিকল্পনা। এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।

Translate »