Type to search

Lead Story জাতীয় বাংলাদেশ রাজনীতি সম্পাদকীয় ও মতামত

নিয়ন্ত্রণহীন দখল-চাঁদাবাজি

সারা দেশে দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু পুলিশ নির্লিপ্ত। প্রতিদিন শত শত অভিযোগ। আর এই কাজে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা ছাড়াও এক ধরনের সুবিধাবাদী গ্রুপ সুযোগ নিচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না পেশাদার অপরাধীরাও। মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাত, জমি থেকে শুরু করে দোকান কিছুই বাদ যাচ্ছে না। নির্মাণাধীন ভবনেও হানা দিচ্ছে চাঁদাবাজরা। ফলে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেন্দ্র থেকে বারবার নির্দেশনা দেওয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামনে আনতে ভয় পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। এই দখলবাজি নিয়ে এর মধ্যে প্রাণও গেছে কয়েক জনের।

সর্বশেষ চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলা সদরে চলমান মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে বাগবিতণ্ডার জেরে হওয়া সংঘর্ষে জাহেদ হোসেন মুন্না (২০) এক যুবদল কর্মী নিহত হয়েছেন। গত সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে দুই পক্ষের পাঁচ জন আহত হয়েছেন। মীরসরাই স্টেডিয়ামে বাণিজ্য মেলায় মীরসরাই পৌরসভা বিএনপির সদস্যসচিব জাহিদ হোসাইনের অনুসারীদের সঙ্গে মীরসরাই পৌরসভা যুবদলের আহ্বায়ক কামরুল হাসানের অনুসারীদের বাগবিতণ্ডা হয়। সেখানে জাহিদ হোসাইনের অনুসারীদের হামলায় আহত হন কামরুল হাসানের কয়েক জন কর্মী। পরে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে কামরুলের অনুসারীরা জাহিদ হোসাইনের বাড়িতে এবং তার অনুসারীদের ওপর হামলা চালায়। এ হামলায় মীরসরাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন গলিতে যুবদল কর্মী জাহেদ হোসেন মুন্না গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে মীরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গাজীপুরে আটকের পর থানা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল সিকদারকে ছাড়িয়ে নিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জামায়াত নেতারা। একটি মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে পুলিশ সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুলকে আটক করে। আটকের পর জামায়াতের ৭০ থেকে ৮০ জন নেতাকর্মী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে থানা প্রাঙ্গণে যান এবং শফিকুলকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানান। জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল হালিম বলেন, গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঐ আওয়ামী লীগ নেতাকে আটক করা হয়। তাকে ছাড়িয়ে নিতে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা থানায় এসেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর গাজীপুর সদর উপজেলার নায়েবে আমির আব্দুল বারী স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ যাকে ধরেছে, তিনি বর্তমানে আমাদের সংগঠনের লোক।

এই ধরনের চিত্র গোটা দেশ জুড়ে। কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ কী করছে? জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘দখল এবং চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সবগুলো ইউনিটের প্রধানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন কিন্তু যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না।

আবার জুলাই অভ্যুত্থানের পর গণহারে যে মামলা হয়েছে সেখানেও বাণিজ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে এগুলো স্বীকারও করা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। এর মধ্যে বিএনপির সঙ্গে মিশে গেছে সুবিধাবাদীদের একটি গ্রুপ। সুযোগ বুঝে তারাও নেমেছেন চাঁদাবাজি আর দখলবাজিতে।

মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. তারিকুল ইসলামকে ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গ্রেফতার করে পুলিশ। মারামারির ঘটনায় গত ১৯ নভেম্বর শ্রীনগর থানায় একটি মামলা হয়। ঐ মামলার এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি তরিকুল। তাকে ছাড়িয়ে নিতে প্রথমে থানায় যান বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তারা তরিকুলকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে চাপ দেন। কিছুক্ষণ পর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা থানা প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকেন। পুলিশের সঙ্গে তারা বাগবিতণ্ডা শুরু করেন। একপর্যায়ে রাত ১০টার দিকে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে জোর করে ওসি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের সামনে থেকে আসামি তরিকুলকে ছিনিয়ে নিয়ে যান তারা। যদিও পরে তরিকুলকে আবারও গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

যুবদল নেতাকে থানাহাজত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে অবরোধ করে প্রতিবাদ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এ সময় আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের দাবিতে স্লোগান দেওয়া হয়। এই ঘটনায় শ্রীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাইয়ুম উদ্দিন চৌধুরীকে মুন্সীগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে ক্লোজড করা হয়েছে। তরিকুল ইসলামকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শুধু তরিকুল নয়, এমন অনেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। তার পরও নেতাকর্মীদের থামানো যাচ্ছে না।

রাজধানীর হাতিরঝিলের বাগিচারটেক এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীকে মারধর করে তার নিজের জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় প্রবাসী মামুদ আলম ভূঁইয়ার ভাতিজা রকিবুল করিম ভূঁইয়া সোমবার রাতে হাতিরঝিল থানায় একটি জিডি করেছেন। জিডির অভিযোগে বলা হয়, হাতিরঝিল থানাধীন বাগিচারটেক প্লট নম্বর-১৯/সি জমির ওপর স্থানীয় সন্ত্রাসীরা নজর দেয়। গত ১ জানুয়ারি রাতে স্থানীয় সন্ত্রাসী সাইফুল, বিল্লাল, বাদশাসহ ১৫-২০ জন ঐ জমি দখল করতে যায়। এ সময় মামুদ আলম বাধা দিলে সন্ত্রাসীরা তাকে এলোপাথাড়ি মারধর ও জখম করে। ঐ জমি ছেড়ে না দিলে তিনি এবং তার পরিবারের ওপর বড় ধরনের বিপদ আসবে বলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। স্থানীয় একজন প্রভাবশালী বিএনপি নেতা সেই কাজে বাধা দেন। সেনাবাহিনী এসেও তাদের কাজে বাধা দিতে নিষেধ করে। কিন্তু নানা অসিলায় ঐ ব্যবসায়ীকে নির্মাণকাজ করতে দিচ্ছেন না ঐ বিএনপি নেতা। একপর্যায়ে ঐ নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসেন ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি। সেখানে তিনি একটি ফ্ল্যাট দাবি করেন। যার মূল্য ১ কোটি টাকা। পরে দেনদরবার করে ৪০ লাখ টাকা দাবি করেন বিএনপি নেতা। কিন্তু ঐ ব্যবসায়ী এত টাকা দিতে রাজি হননি। ফলে তার নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। কবে চালু করতে পারবেন সেটাও নিশ্চিত নয়। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের সাগরিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরেই গত ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একজন কৃষক ও তার ছেলেকে পিটিয়েছেন স্থানীয় দুই যুবদল নেতা।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজধানীর মার্কেটগুলোতেও নিয়ন্ত্রণ বদলে গেছে। এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের দখল নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন আর পিচ্চি হেলালের মধ্যে একদফা কোপাকুপিও হয়ে গেছে। গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়ার সব মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হয়েছে। প্রতিটি মার্কেট কমিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিএনপির দলীয় পরিচয় দিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে আছেন ব্যবসায়ীরা। এই দখলকে কেন্দ্র করে গুলিস্তানের ঢাকা ট্রেড সেন্টার উত্তর, ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ, পোড়া মার্কেট এবং ফুলবাড়িয়ার সামনের ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করেছেন তারা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঐ মার্কেটগুলোর সাধারণ ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, এ চাঁদাবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মার্কেট কমিটির দখলদারেরা জড়িত রয়েছেন।

-ইত্তেফাক

Translate »