গ্যারেজ ব্যবসায়ী থেকে শত কোটি টাকার মার্কেটের মালিক প্রতারক নাসিম

বিশেষ প্রতিনিধি : হোসেন নাসিমের ৪৫ বছর আগেও তেমন কিছু ছিল না। সিরামিক্সের পণ্য বিক্রি করত। এ ছাড়া একই দোকানের পাশে ছিল মুরগির খামার ও মুলিবাঁশের ব্যবসা। সঙ্গে আরেক পাশে ছিল বেবিট্যাক্সির গ্যারেজ, যা ভাড়া দিত। মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের বাংলাদেশ চক্ষু হাসপাতালের বিপরীতে ২০ কাঠা জমির ওপর ছিল তার এসবের ব্যবসা। সারাদিন দোকানে বসেই সময় কাটত তার। যা আয় হতো তাতেই চলত সংসার। কিন্তু এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করে মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে করেছে শত-কোটি টাকার মার্কেট। তবে মার্কেটের জমিটিও তার দখল করা। বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ব্যবসা করে নব্বইয়ের দশকের পর হঠাৎ করেই নাসিম প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি বিক্রির কথিত ব্যবসা শুরু করে। রাজধানীর অদূরে সাভারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদের ওপর অন্যের জমিতে ভাড়ায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। শুরু করে জমির প্লট বিক্রির ব্যবসা। স্বল্প দামে এবং সহজ কিস্তিতে ভাসমান পানিতে প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে ব্যাংকের জমানো টাকা, পেনশনের টাকা এবং ব্যবসার টাকা নিয়ে হুমকি খেয়ে তার কাছে ছুটতে থাকে। এ ঘটনা বেশি দিনের নয়, মাত্র ২০ বছর আগের।
প্রতি গ্রাহকের কাছে প্লট বিক্রি বাবদ অগ্রিম ১ লাখ এবং প্রতি মাসে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা কিস্তিতে ১০ বছরের চুক্তি করে। এরপরই তার জীবনযাত্রা বদলে যেতে শুরু করে। এবার তিনি আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যায়। মাত্র দেড় যুগে নাসিম এই প্রতারণা ব্যবসা করেই হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। প্রতারণার টাকা পেয়েই তার জীবনযাত্রা বদলাতে শুরু করে। কিনে ফেলে ব্যক্তিগত গাড়ি, মিরপুর ১-এ তিনতলা এবং পাইকপাড়ার ঝিলপাড়ে ছয়তলা বাড়ি ও বউয়ের নামে ফ্ল্যাট। নিজের নিরাপত্তায় নিয়োগ করে কয়েকজন সুঠাম দেহের অধিকারী তরুণ-তরুণী। তাদের সঙ্গে থাকত অস্ত্র। কোনো রাস্তা দিয়ে নাসিম যাওয়ার সময় নিরাপত্তাকর্মীরা হুইসেল বাজিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিত। যেন কোনো মন্ত্রী বা ভিআইপি যাচ্ছে। মিরপুর এলাকার বিভিন্ন বাসিন্দা, তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কাজ করা কয়েকজন ব্যক্তি ও নাসিমের প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব অজানা তথ্য জানা গেছে।
কথিত নাসিম রিয়েল এস্টেট ভাসমান পানিতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আর এই টাকার পরিমাণ প্রায় ৩৫০ কোটির কম নয়। পুরো টাকাই হাতিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইমাম হোসেন নাসিম, যা র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারও করেছে সে। নাসিম একজন বড়মাপের প্রতারক। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরেই চলছিল তার বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ব্যবসা। কোনো ব্যবসাই সে দীর্ঘদিন করত না। একটাতে সফল হলেই আরেকটা ধরত। সাভারের কাউন্দিয়ায় নদীর ওপরে সাইনবোর্ড দেখিয়ে প্লট বিক্রি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুয়াকাটা, কুমিল্লা এবং দুবাইয়ে প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রির নাম করে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের কাছ থেকে ৩৫০ কোটি টাকা লুটেছে। নাসিম তার মায়ের নামে প্রস্তাবিত মেডিকেল কলেজ, নিজের নামে এয়ারওয়েজ কোম্পানি, বিশুদ্ধ বোতলজাত পানির কোম্পানি, চানাচুর, চিনি, মুড়ি, নাসিম লাচ্চা সেমাই, নাসিম সিরামিকস, নাসিম পোল্ট্রি ফার্মসহ নানা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে কাগজ-কলমে নাসিম গ্রুপ খুলে বসে। কিন্তু তার এসব প্রতিষ্ঠানের বাস্তবে কোনোটিরই অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। নাসিম যে একজন প্রতারক তা ভুক্তভোগী ও প্রতারিত ব্যক্তিরা ঘুণাক্ষরেও দেড় যুগে আঁচ করতে পারেনি। কারণ থানা পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই সে এসব করত। প্লট আজ দেব, কাল দেব বলে গ্রাহকদের নানা আশ্বাসের বাণী শোনাত। বেশিরভাগ সময় তার অফিসের নিচে থাকা গুপ্ত ঘরে আত্মগোপন করত। কিন্তু ২ অক্টোবর র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর তার প্রতারণার চাঞ্চল্যকর কাহিনি বেরিয়ে আসতে শুরু করে।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, নাসিম মিরপুরের যে অফিসটিতে বসত সেই ২০ কাঠা জমিটিও দখল করা। স্বাধীনতার পর ওই জমিটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। কোনো এক সময় সুযোগ বুঝে সে সেটি দখল করে নেয়। পরবর্তী সময়ে সে একটি তিনতলা মার্কেট নির্মাণ করে। মার্কেটটিতে এখন বিভিন্ন দোকান ও শোরুম ভাড়া দেওয়া, যা থেকে প্রতি মাসে তার আয় প্রায় ৭ লাখের কাছাকাছি। কিন্তু আপাতত সেই ভাড়া তোলাও বন্ধ রয়েছে। তার দখল করা ২০ কাঠা জমির ওপর এই মার্কেটের মূল্য আনুমানিক প্রায় ১০০ কোটি টাকা বলে জানা গেছে।
নাসিমের প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রিলমিস্ত্রি জানান, তিনি কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে একটি ছয়তলা ভবনের জানালার গ্রিল লাগানোর কাজ করেছেন। এ ছাড়াও পাইকপাড়া এবং মিরপুরে তার তিনতলা দুটি বাড়ির কাজেও তাকে নিয়েছিল নাসিম। তবে চট্টগ্রামে কিছু গ্রাহককে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিলেও ঢাকা, কুমিল্লা, কুয়াকাটার কোনো গ্রাহককেই সে কোনো টাকা ফেরত দেয়নি এবং প্লটও বুঝিয়ে দেয়নি। তিনি আরও জানান, নাসিম প্রতি মাসে দু-তিনবার দুবাই, কাতার ও মালয়েশিয়া যেত। মালয়েশিয়ায় তার মেয়ে থাকায় সেখানে মেয়েকে টাকাও পাঠাত।
অনুসন্ধানে যা জানা গেছে, টানা সাত দিন নাসিমের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাসিম প্রতারণার টাকা দিয়ে মিরপুর ১-এ একটি তিনতলা বাড়ি, চিড়িয়াখানা রোডে তিনতলা একটি মার্কেট এবং কল্যাণপুরের পাইকপাড়ার ঝিলপাড়ের উল্টো পাশে একটি ছয়তলা বাড়ি করেছে। এ ছাড়াও কেরানীগঞ্জ, সাভার ও কাউন্দিয়ায় তার জমি রয়েছে। এসব জমি ও সম্পত্তির হিসাব করলে তা প্রায় কয়েকশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। চিড়িয়াখানা রোডে থাকা নাসিমের ভবনের ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের জুন মাস থেকে প্রতিদিন ২০-২৫ জন করে গ্রাহক তার কাছে পাওনা টাকা চাইতে আসত। এ নিয়ে প্রায় দিনই নাসিম ও তার লোকজনের সঙ্গে গ্রাহকদের তর্ক এবং বাকবিতণ্ডা লেগে থাকত। নাসিমের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভুক্তভোগীরা মিরপুর থানায় কয়েক বছরে প্রায় আড়াইশ’ অভিযোগ করলেও অদৃশ্য কারণে সেগুলোর কোনো তদন্ত হয়নি। এমনকি অভিযোগগুলোর বিষয়ে নাসিমকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। নাসিমের নামে কেউ জিডি বা মামলা করলেই সেটির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তার ছিল পাঁচজন আইনজীবী। ওই আইনজীবীরাই মূলত তাকে বিভিন্ন মামলায় জামিন থেকে শুরু করে কীভাবে আইনি রক্ষা পেতে হবে তা জানাতেন বলে ভুক্তভোগী ও র্যাব জানিয়েছে। নাসিম প্রতারণা টাকা কখনই নিজের কাছে রাখত না। এসব টাকায় নাসিম বাড়ি-গাড়ি কেনার পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় থাকা মেয়ের কাছে টাকা পাঠাত। তবে একাধিক বিয়ে করার কারণে নাসিমকে বিভিন্ন ঝামেলায়ও থাকতে হতো। তবে সাভারের কাউন্দিয়ায় পানির ওপর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, সেই সাইনবোর্ডগুলোর এখন আর অস্তিত্ব নেই। ধুরন্ধর নাসিম মুড়ি, চিনি, লবণ, পানি, তার নামে এয়ারওয়েজ, মায়ের নামে আনোয়ারা মেডিকেল কলেজ প্রস্তাবিতসহ প্রায় ২২টি প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছিল। কিন্তু সবই ছিল কাগজ-কলমে। যেগুলোর বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
তালা ঝুলছে নাসিমের অফিসে : গত সোমবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, নাসিমের চিড়িয়াখানা রোডে থাকা অফিসটি এখন বন্ধ। তাকে গ্রেফতারের পর সেটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। গেটে দুটি তালা ঝুলছে। ভেতরে অফিসের মালামাল তছনছ হয়ে পড়ে রয়েছে। কয়েকটি ফ্যান ঝুলছে। তবে এখনও তার ভবনের দ্বিতীয়তলার সামনে ঝুলছে নাসিম রিয়েল এস্টেটের সাইনবোর্ড। বারান্দার ব্যালকনিতে ঝুলছে তিনটি ব্যানার। তাতে লেখা রয়েছে, ‘প্রতারক নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিকের কাছে টাকা চাই, প্রচারে ভুক্তভোগী।’
মার্কেটের দোকানিরা যা বললেন : নাসিমের অবর্তমানে মিরপুরে তার অফিস ভবনের দোকানগুলোর ভাড়া এখন আর কেউ তুলছে না। তবে দোকানিরা শুধু বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল পরিশোধ করছেন বলে জানিয়েছেন তারা। র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে প্রত্যেক দোকানিকে কাউকে ভাড়া না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তবে ভাড়া তোলা ও জামানত ফেরতের বিষয়ে কবে সিদ্ধান্ত আসবে তা নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।
দোকানিরা জানিয়েছেন, তারা প্রত্যেক মাসে তাকে বিদ্যুৎ বিল ও ভাড়ার টাকা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু নাসিম গ্রেফতারের পর বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ভবনটির বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছিল। পরে তারা জানতে পারেন নাসিম তিন মাসের বিদ্যুৎ বিল দেয়নি। এ অবস্থায় তারা বসে মিটিং করে ১০ লাখ টাকা বকেয়া বিল পরিশোধ করেছেন। তারা আরও জানিয়েছেন, প্রত্যেকে ২০-৫০ লাখ টাকা করে জামানত দিয়েছেন। কিন্তু এখন সে টাকা আর ফেরত পাবেন কি না, তার অবর্তমানে দোকান ভাড়া কে তুলবে, সেখানে দোকান চালানো এবং মামলা শেষ হলে ভবনটি আদালতের নির্দেশে ভাঙা হতে পারে কি না তা নিয়ে সন্দেহে রয়েছেন তারা। তাদের মধ্যে এ নিয়ে একধরনের আতঙ্কও বিরাজ করছে। ভবনটির ছাদে থাকা ফাস্টফুডের রেস্টুরেন্ট দ্য হাব রুফট রেস্টুরেন্টের মালিক আসিফ জানান, তিনি ১০ লাখ টাকা জামানত দিয়েছেন। প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দিতেন; কিন্তু এখন সেই জামানতের টাকা পাবেন কি না তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন। তিনি জানান, নাসিমকে যে টাকা জামানত দিয়েছি তা তো আর মনে হয় না পাব! তা ছাড়া ভবনটিতে থাকা নিয়ে ভয় কাজ করছে কখন কে এসে দাবি করে। যেহেতু মালিক নেই এ অবস্থা কতদিন চলবে তা তো বোঝা যাচ্ছে না। তার মামলাগুলো কতদিন চলবে সেটাও একটা বিষয়। দ্বিতীয় তলায় থাকা ফার্নিচারের দোকান অটবির এক নারী কর্মচারী জানান, টাকা ফেরত পাব কি না তা নিয়ে চিন্তিত। কতদিন ভবনটিতে থাকতে পারব সে শঙ্কা তো আছেই।
র্যাব-৪-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আকতারুজ্জামান জানান, মিরপুরে তার যে মার্কেটটি রয়েছে তা শত-কোটি টাকার কম নয়। এ ছাড়াও তার দুটি বাড়ি ও কিছু জমিজমার তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা তার সব সম্পত্তি ও প্রতারণার তথ্য সিআইডিতে দিয়েছি। তারা ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মানি লন্ডারিংয়ের মামলার তদন্ত করছে। এ ছাড়াও র্যাবের পক্ষ থেকে মাদক, প্রতারণা, মানি লন্ডারিং, অর্থ আত্মসাৎ ও অস্ত্র আইনে ছয়টি মামলা করা হবে। মামলা করার জন্য আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষায় আছি। যেসব প্রতিষ্ঠান খুলে গ্রুপের দাবি করত তা পুরোটাই ছিল ভুয়া ও প্রতারণা।
র্যাব-৪-এর অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, খুব শিগগির সিআইডি নাসিমের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করবে। তদন্তে ব্যাংক হিসাব এবং সম্পত্তিসহ সব তথ্য উঠে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এবিসিবি/টিএস