Type to search

Lead Story অপরাধ

গরিবের ভাগ্য বদলের প্রকল্পে লুটপাট: আইএমইডি

প্রায় ছয় হাজার গরু ও ছাগলের চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা বাবদ ৩ বছরে ব্যয় দেখানো হয়েছে দুই কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এই অর্থ বিতরণ করা হয় বিকাশের মাধ্যমে। বিকাশ লেনদেনের তথ্য বলছে, সুফলভোগীদের সেলফোনে এক কোটি ৬২ লাখ টাকা ঢুকেছে। বাকি এক কোটি ১৫ লাখ টাকা বিতরণের কোনো প্রমাণ নেই। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের চলামান প্রকল্পটিতে সম্প্রতি এই অনিয়ম ও দুর্নীতির খোঁজ পেয়েছে সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সূত্রে তথ্যগুলো জানা গেছে।

আইএমইডির তথ্যে দুর্নীতির আরও খবর পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, এ প্রকল্পে বরাদ্দের ৮৯ শতাংশ অর্থ (দুই কোটি ৬৭ লাখ টাকা) খরচ করে ৪৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে ১১ হাজার ৩২৬ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছে। একটিও হস্তচালিত নলকূপ সরবরাহ না করেই ৬২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। অফিস না থাকলেও ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ ১১ লাখ টাকার খরচের কথা বলা হয়েছে। কৃষি ও বন্যা পুনর্বাসন খাতে মাত্র ১০ লাখ টাকা বিতরণ করে এক কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এভাবে প্রায় সব খাতে টাকা হরিলুট করা হয়েছে চরের হতদরিদ্র অধিবাসীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি প্রকল্পে।

সূত্র জানিয়েছে, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার চর এলাকায় বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ), বগুড়া। ৩০ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৭ সালের জুলাইতে। গত তিন বছরে প্রকল্পে কোনো অডিট সম্পন্ন হয়নি। সক্ষমতা বৃদ্ধি, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর, গবাদিপশু লালন ও বাজার ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ সৃষ্টি করাই ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। কিন্তু আইএমইডির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পের প্রতিটি খাতে বরাদ্দের অধিকাংশ অর্থই খরচ হলেও কাজ হয়েছে নামমাত্র। দরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নতি না হলেও প্রকল্প সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের পকেট ভারি হয়েছে। আইএমইডি এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমবায় বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে।

গত নভেম্বরে আইএমইডির একটি প্রতিনিধি দল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন চলতি মাসে সমবায় বিভাগে পাঠিয়েছে।

দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও আরডিএ (বগুড়া)-এর পরিচালক (প্রশিক্ষণ) সমীর কুমার সরকার প্রকল্পে অনিয়মের কথা অস্বীকার করেন। আইএমইডির মূল্যায়ন সঠিক নয় বলে তিনি সমকালকে জানান। সমীর কুমার বলেন, করোনা ও বন্যার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর প্রকল্পের ঘাটতিগুলো পূরণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আরডিএ কর্তৃপক্ষ নিজেরাও একটি তদন্ত কমিটি করে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখেছে। আরডিএর নিজস্ব তদন্ত কমিটিও প্রকল্পটিতে কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি বলে তাদের প্রতিবেদনে উলেল্গখ করেছে বলে জানান সমীর কুমার।

এ বিষয়ে জানতে আরডিএ (বগুড়া) মহাপরিচালক খলিল আহমদও প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘাটতির কারণ হিসেবে করোনা মহামারিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, করোনায় প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন বিতরণ কার্যক্রম- অটোরিকশা, পাম্পসহ অন্যান্য কর্মকা ঠিক মতো করা সম্ভব হয়নি। এখন সব কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। এ মাসের মধ্যে ঘাটতিগুলো সব পূরণ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, প্রতিবেদন পাওয়ার পর আরডিএর অতিরিক্ত মহাপরিচালক সুফিয়া নাজিম সার্বক্ষণিক বিষয়টি দেখভাল করছেন। আইএমইডির প্রতিবেদন পাওয়ার পর চলতি সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি প্রকল্পের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

পদে পদে অনিয়ম: প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় সৌরশক্তি ব্যবহার করে ১২শ পরিবারকে পানি সরবরাহের জন্য দুই কোটি ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর আওতায় চারটি গভীর নলকূপ স্থাপন, ২০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার ওভারহেড ট্যাংক নির্মাণ ও পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক স্থাপনের কথা ছিল। আইএমইডির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দরপত্রে উল্লেখিত শর্তের চেয়ে কম ক্ষমতার সোলার পাম্প ও সৌরপ্যানেল বসানো হয়েছে। ১২শ পরিবারে পানি সরবরাহের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০০ পরিবারের পানির লাইনে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কোট করা মূল্যের চেয়ে ২০ লাখ টাকা বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে। ৩০০ পরিবারকে কোনো ধরনের হস্তচালিত নলকূপ সরবরাহ না করেই ৬২ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এক কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে দেড় হাজার পরিবারে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ৪৮৯ পরিবারকে। অর্থাৎ বরাদ্দের শতভাগ ব্যয় করে লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।

গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রকল্প এলাকায় দুটি ইউনিট স্থাপনের কথা ছিল। তা না করে আরডিএর কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে কিছু মালপত্র সরবরাহ করেই ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ বরাদ্দের ৮৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে ৪০ শতাংশেরও কম কাজ করা হয়েছে।

ডিপিপি অনুযায়ী, স্যাটেলাইট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। কোনো ক্লিনিক স্থাপন না করেই এ খাতের পুরো টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

৩০টি সাইলেজ চপিং মেশিন (প্রতিটির মূল্য ৪৫ হাজার টাকা), আটটি নছিমন (প্রতিটির মূল্য দুই লাখ টাকা) সরবরাহসহ ৩০০ পরিবারে নানা সহায়তার জন্য ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হলেও কোনো নছিমন অথবা সাইলেজ চপিং মেশিনের অস্তিত্ব পায়নি আইএমইডির পর্যবেক্ষক দল।

ব্যয় দেখানো হলেও প্রকল্পের আওতায় কোনো যন্ত্রপাতি যেমন- কৃত্রিম প্রজনন ইউনিট, দুগ্ধ বাজারজাতকরণ ইউনিট, গভীর নলকূপ স্থাপন, সাইলেজ চপিং মেশিন, নছিমনসহ অন্যান্য সরঞ্জামদি সংগ্রহ ও বিতরণের কোনো রেজিস্টারের খোঁজ মেলেনি। ছয় হাজার ফলদ ও বনজ বৃক্ষ রোপণের কথা থাকলেও গত অক্টোবর পর্যন্ত ৯৩২টি চারা বিতরণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তব অর্জন ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

গরু মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রকল্পে ৭৫০ পরিবারে গরু পালার জন্য ৭৫০টি শেড নির্মাণ বাবদ ৫৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ওই পরিবারগুলোকে চার মাস গরুর খাবার সরবরাহের জন্য আরও ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু গরু পালার এই শেড নির্মিত হয়নি। কোনো খাবারও সরবরাহ করা হয়নি। যদিও বরাদ্দ করা অর্থের শতভাগ ব্যয় দেখানো হয়েছে।

গরুর দুধ বাজারজাতের সুযোগ সৃষ্টির জন্য আটটি ইউনিট নির্মাণের কথা ছিল। এ-সংক্রান্ত টেন্ডার ডকুমেন্টে আটটি ব্রাইন চিলার (৫০০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন), ১২টি মিল্ক্ক কেয়ারিং ভ্যান (৫০০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন), ১৬টি মিল্ক্ক কেয়ারিং ভ্যান (পোর্টেবল চিলার), ৩টি অটোমেটিক ইনকিউবেটর, ৮টি ক্রিম সেপারেটর, দুধ পরীক্ষার জন্য ৮ সেট যন্ত্রপাতি, ৩ সেট দধি প্রস্তুতকরণ সরঞ্জাম, ৮ ইউনিটের ব্যবস্থাপনা সহায়তাসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি বাবদ মোট এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে দুটি ইউনিট (সোনাতলা উপজেলায় একটি ও সারিয়াকান্দি উপজেলায় একটি) মিলে ৩০০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ব্রাইন চিলার, ২টি অটোমেটিক ইনকিউবেটর, ২ সেট দধি প্রস্তুতকরণ সরঞ্জাম, ২টি জেনারেটর, ৮টি কড়াইসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি কেনা হয়। মাঠ পর্যায়ে কোনো মিল্ক্ক কেয়ারিং ভ্যান (পোর্টেবল চিলার), ক্রিম সেপারেটর দেখতে পায়নি আইএমইডির পর্যবেক্ষণ দল। নির্মিত ইউনিট দুটিও বর্তমানে অকার্যকর। অথচ এ খাতে বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ করে এক কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ডিপিপিতে ভ্রমণের জন্য বরাদ্দ পাঁচ লাখ টাকার পুরোটা ব্যয়ের কথা বলা হলেও নথিপত্রে দেড় লাখ টাকা ব্যয়ের হদিস মিলেছে, যার অর্ধেক আবার খরচ হয়েছে প্রকল্পবহির্ভূত কাজের ভ্রমণে। প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে কমিটি গঠন না করেও কমিটির বৈঠকের সম্মানি বাবদ সাত লাখ টাকা খরচের হিসাব দেওয়া হয়েছে। সমকাল

Translate »