Type to search

Lead Story বাংলাদেশ রাজনীতি

হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক আনুগত্যের বিবেচনায় বরাদ্দ হয় প্লট

শুধু মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী আদর্শের রাজনীতিক নন। সরকারের বিশেষ কোটায় রাজউকের প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকায় আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িচালক (ড্রাইভার) এবং আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের অফিস সহকারীরাও (পিওন)। এছাড়া হাসিনা সরকার বিশেষ আস্থাভাজন বিবেচনায় বিচারপতি, আমলাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিকে ইচ্ছামতো প্লট বরাদ্দ দেয়। রাষ্ট্রীয় বিশেষ অবদানের কোটায় প্লট দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় ‘রাজনৈতিক আনুগত্যের বিবেচনা’।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ আমলে রাজউকের অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস রুলসের ১৩/এ উপবিধির (অসামান্য অবদান) অধীনে এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে বলা হয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী, সরকারি চাকরিজীবী এবং রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিরা অসামান্য অবদান কোটায় প্লটের আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া রাষ্ট্র বা সরকার যদি কাউকে বিশেষ অবদান রেখেছেন বলে নির্বাচন করে, তাহলে তিনি প্লট পাবেন।

তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আগেও ১৯৬৯ সাল থেকে বৈষম্যমূলক হিসাবে বিবেচিত ১৩ ধারা বিদ্যমান ছিল। ১৯৮৬ সালে এক দফা সংশোধনের পর এটি ১৩/এ ধারা এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার ২৫ আগস্ট সংশোধিত গেজেটে ১৩এ (১) এ, বি, সি বিধি প্রণয়ন করে। এর আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় বহু প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা নিয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। বর্তমান সরকার এর সবই তদন্তের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বিএনপি জমানায় প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত ফাইল রাতারাতি রাজউক থেকে গায়েব হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ইতঃপূর্বে রাজউকের আবাসন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও বাড্ডা।

মোদ্দা কথা, সব সরকারের আমলে রাষ্ট্রের জন্য অসামান্য অবদান রাখার বিশেষ কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। এজন্য শুরু থেকেই রাজউকের প্রতিটি আবাসন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে কমবেশি অনিয়ম হয়েছে।

রাজউক বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে পতনের আগ পর্যন্ত হাসিনা সরকারের আমলে হাজারেরও বেশি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ সময় নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। এতে অনেকটা ফ্রিস্টাইলে যাকে খুশি তাকে প্লট দেওয়ার রেওয়াজ তৈরি হয়। সরকার পতনের পর রাজউকের আলোচিত পূর্বাচল, উত্তরা ও ঝিলমিল প্রকল্পে বিপুলসংখ্যক প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকা হালনাগাদের কাজ এখনো চলমান।

১২ গাড়িচালক : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িচালক নুরুল আলম, নুর নবী ও শাহিনের নামে বিশেষ কোটায় প্লট বরাদ্দ দিতে গত বছর ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পত্র দেওয়া হয়। এতে তড়িঘড়ি প্লট বরাদ্দে তৎপর হয়ে ওঠে রাজউক। দ্রুততম সময়ে তাদের নামে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে পাঁচ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি এটি রাজউকের বোর্ড সভায় অনুমোদন পায়। এই তিনজনসহ তালিকায় থাকা ১২ জন গাড়িচালকের মধ্যে অন্যরা হলেন মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম লিটন, মিজানুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, বোরহান উদ্দিন ও মাহবুব হোসেন গং। তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় বিশেষ অবদান কোটায় (১৩/এ) প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।

অফিস পিওন : গাড়িচালক ছাড়াও বিশেষ কোটায় রাজউকের বহুমূল্যবান প্লট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের বেশ কয়েকজন অফিস সহকারী (পিওন)। তাদের মধ্যে উত্তরা প্রকল্পে প্লট পান মিজানুর রহমান মিন্টু ও শেখ লোকমান। এছাড়া প্লটপ্রাপ্তদের তালিকায় আছেন দলীয় আস্থাভাজন রফিকুল ইসলাম ও মো. সামসু নামের দুজন তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ব্যক্তি। রাজউকের নথিতে তাদের প্লট প্রাপ্যতা সম্পর্কে লেখা হয় ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’।

প্লট পেয়েছেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ ওরফে ডিবি হারুনের মা জহুরা খাতুন, ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পলাতক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সিদ্দিকী নাজমুল আলম, চিত্রনায়িকা বেগম অরুণা বিশ্বাস, বেগম অঞ্জনা সুলতানা, অভিনেত্রী ও সংসদ-সদস্য সুবর্ণা মোস্তাফা, জয়া আহসান, প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, শমী কায়সার, কবি অসিম কুমার সাহা ও বেগম মিনা বড়ুয়া। তাদের মধ্যে অরুণা বিশ্বাস ও শমী কায়সার আগস্টে রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘আলো আসবেই’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে ব্যাপকভাবে সমালোচনামুখর ছিলেন। এমনকি রাজপথ অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের ধরে কঠোর শাস্তির কথাও বলেন। অবশ্য ৫ আগস্টের পর অরুণা বিশ্বাস দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এছাড়া অভিনেত্রী শমী কায়সার গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

প্লটের বন্যা : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই প্লট ভাগাভাগিতে নেমে পড়েন। যে যার ইচ্ছামতো প্রভাব খাটিয়ে নামমাত্র মূল্যে বহু মূল্যবান প্লট বাগিয়ে নেন। এ তালিকায় আছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক প্রটোকল অফিসার এসএম খুরশিদ উল-আলম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এডিসি নাঈম হাসান, মোহাম্মদ ইলিয়াস রাসেল, অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার বেগম ফাতেমা ইয়াসমিন ইভা, মোহাম্মদ শামীম মুসফিক, আরিফুজ্জামান নূরন্নবী, ব্যাপক প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত সেই অ্যাসাইনমেন্ট অফিসার গাজী হাফিজুর রহমান ওরফে লিকু। এছাড়া প্লট পান সাবেক প্রভাবশালী এনডিসি ড. নমিতা হালদার, সহকারী প্রেস সচিব নূর এলাহি মিনা, উপ-প্রেস সচিব নজরুল ইসলাম, আশরাফুল আলম খোকন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মকবুল হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্যামেরাম্যান মোহাম্মদ দিদারুস সালাম।

রাজউক কর্মকর্তারা : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজউকে ঘাঁটি গাড়েন মেজর (অব.) সামসুদ্দিন আহম্মদ। তিনি রাজউকের সদস্য হিসাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। বিশেষ কোটায় তিনিও রাজউকের প্লট পান।

সূত্র বলছে, সামসুদ্দিন রাজউকে হাসিনার নিজস্ব লোক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এ কারণে দফায় দফায় তার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। রাজউকে বসে তিনি রীতিমতো ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতেন। এছাড়া রাজউকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোয়েন্দা সংস্থার ভয় দেখিয়ে নানা ধরনের সুবিধা আদায় করতেন সামসুদ্দিন। হাসিনার আমলে তাকে রাজউক থেকে সরানোর চিন্তাও করা যায়নি। তবে সরকার পতনের পর তার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। শেষ পর্যন্ত রাজউকের মায়া ত্যাগ করে তাকে সরে যেতে হয়। তবে সামসুদ্দিন একা নন। ডজনেরও বেশি রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের বিশেষ কোটায় রাজউকের প্লট বরাদ্দ পান। এদের মধ্যে আছেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সাইদ নূর আলম, সদস্য যুগ্মসচিব নাসির উদ্দিন, নুরুল ইসলাম ও খুরশিদ আলম। তবে রাজউক ছাড়াও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রালয়ে পোস্টিং নিয়েই অনেকে রাজউকের প্লট বরাদ্দের পথে হাঁটেন। এদের মধ্যে আছেন সাবেক পূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, অতিরিক্ত সচিব শওকত আলী, আরিফুর রহমান, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান, উপসচিব রকিবুর রহমান, লুৎফুন নাহার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা খসরুজ্জামান ও সামসুন্নাহার বেগম।

হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট হিসাবে প্লটপ্রাপ্তদের তালিকায় আছেন দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিত রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনের নাম। তিনি অবসরে যাওয়ার পর রেলওয়ের আলোচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাসট্রাকচার লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আমজাদ সপরিবারে দেশ ছাড়েন। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আমজাদের জামাতা মামুনুল ইসলামকে রেল বিভাগে প্রাইজ পোস্টিং দেয়। বর্তমানে মামুনুল ইসলাম রেলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা বা জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রাষ্ট্রীয় অবদানের কোটায় প্লট পেয়েছেন বেশ কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। এদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) উপপরিচালক এসএম আকবর হোসেন, হারুনুর রশিদ গং, বহুল আলোচিত প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই) কর্মকর্তা হামিদুর রহমানের স্ত্রী ফারহানা সিদ্দিকী, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) আসাদুজ্জামান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের ব্যক্তিগত সচিব একেএম শামসুল আলম, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও সাবেক ডিএমপি (ঢাকা মহানগর পুলিশ) কমিশনার হাবিবুর রহমান।

গরিবের বন্ধু বাদশা : রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা সময় নিজেকে শ্রমজীবী শ্রেণির প্রতিনিধি বলে প্রচার করে এসেছেন বামপন্থি নেতা এবং ওয়াকার্স পার্টির সাবেক এমপি ফজলে হোসেন বাদশা। কিন্তু ক্ষমতার চেয়ারে বসেই ভোল পালটান তিনি। আওয়ামী ক্ষমতার প্রভাবে খোদ নিজের নামে রাজউকের প্লট বাগিয়ে নেন বাদশা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন শুধু প্লট নয়, ২০০৯ সালে মহাজোটের পক্ষে নৌকা প্রতীকে ভোট করেন বাদশা। জীবনে প্রথমবার এমপি হওয়ার পরপরই আমূল বদলে যান তিনি। নিজের নির্বাচনি এলাকা রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতেন হেলিকপ্টার অথবা বিমানে। ব্যবহার করতেন একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। এছাড়া তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠে। কথিত বিশেষ অবদান বা রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন বৈষম্যমূলক প্লট বরাদ্দের সংস্কৃতি কীভাবে বন্ধ করা যাবে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, প্রথম কাজ হবে রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতা যে বৈষম্যমূলক চেতনা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে তার বাস্তবায়ন। এর কোনো বিকল্প নেই। এর আলোকে সংশ্লিষ্টদের বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে যারা সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের বৈষম্যমূলক বিধিবিধান প্রণয়ন এবং প্রয়োগে যারা যুক্ত ছিলেন তাদেরকেও অবশ্যই আইনের আওতায় আনা দরকার। তা না হলে কোনোভাবেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। শুধু কিছু সংস্কার বা আইন করে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়ার এই প্রবণতা কিছুতেই রোধ করা যাবে না।

-যুগান্তর

Translate »